এখন তা বেশ বুঝতে পারছি।
প্রতিভার নিকট একটা প্ল্যান পেয়েছি, এতে স্পষ্টই এখন বোঝা যাচ্ছে যে,যেখানে জহরত আছে, খুব সম্ভব পোঁতা ছিল, প্ল্যানে তাহাই দেখান হয়েছে।
এখন তাও বেশ বুঝতে পাছি।
প্ল্যানে চার জন লোকের সই আছে, সুতরাং কেবল তারাই চার জন এই জহরতের কথা জান্ত। তারা কোন কারণে,সম্ভবমত খুন করে দ্বীপান্তর যায়। সেখানে ডাক্তার বাবু আর কমিসরিয়েট বাবু তাদের কাছ থেকে কোন গতিকে জহরতের কথা জানতে পারেন, প্ল্যান ও হস্তগত করেন। শেষে সমুদয় জহরত বরেন্দ্র বাবুর গুণবান্ পিতাই আত্মসাৎ করেন।
ত সবই এখন বেশ বুঝতে পাছি। কিন্তু এক-পেয়ের সেই সঙ্গীটি কে?
তা ত বলেই দিলাম। আপনি কি জানেন না যে, আন্দামান বাসীর আকার ভারি ছোট। তাদের মধ্যে যে খুব বড় সে আমাদের দেশের বার-তের বৎসরের ছেলের মতও নয়।
এক-পেয়ে তা হলে একজন আন্দামানের লোককে সঙ্গে করে এনেছিল?
সেকথা আর দুবার করে বতে। তার পর এক-পেয়ের নাম আপনি কেমন করে জানলেন?
অতি সহজে। দু-তিন বৎসরের সব খবরের কাগজ দেখতে আরম্ভ করেছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখলেম যে, দেড় বৎসর আগে আন্দামান দ্বীপ থেকে আবদুল বলে একজন দায়মালি কয়েদী পালিয়েছে, তার খোঁজ হচ্ছে। তার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। তার একটা পা কাঠের ছিল—এই যে এদিকেও ভোর হয়ে এসেছে-এখন কাজে লাগা যাক।
একাদশ পরিচ্ছেদ।
একটু পরিষ্কার হইলে লোক চলাচলের আগে গোবিন্দ বাবু উঠিয়া রাস্তা বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। সহসা বলিয়া উঠিলেন, দেখছেন?
আমি স্পষ্টই সেই বালকের পায়ের দাগ দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ। এও দেখুন।
আমি। তাই ত!
আমি পথে সেই কাঠের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এখন দেখা যা আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু জহরতের সিন্দুকটি নিয়ে কোন্ দিকে গিয়েছিলেন। দেখছেন না, পায়ের দাগে স্পষ্টই জাতে পারা যায় যে, একটা ভারি জিনিষ নিয়ে গেছে।
গোবিন্দ বাবু পায়ের দাগগুলির উপরে লক্ষ্য রাখিয়া চলিলেন, আমিও পশ্চাতে পশ্চাতে চলিলাম। তখনও রাস্তায় লোকের চলাচল আরম্ভ হয় নাই।
আমরা সেই পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া কত রাস্তা ঘুরিয়া ক্রমে যমুনার নিকট আসিলাম। সেখানে একখানা খোলর ঘরের সম্মুখেও সেইরূপ পায়ের দাগ দেখিলাম; আবার সেখান হইতে সেই দাগ যমুনাতীর পর্যন্ত গিয়াছে। তাহার পর আর কোন চিহ্ন নাই।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি বুঝলেন?
আমি। এক-পেয়ে খোলার ঘরে কার সঙ্গে দেখা করে তার পর নদীর ধারে এসেছিল।
গোবিন্দ। কেবল তাই নয়। দেখছেন না, আরও দুজনের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।
আমি। হাঁ, তা দেখতে পাচ্ছি।
গোবিন্দ। এ দুজন লোককে ডেকে নিয়ে এক-পেয়ে বন্ধু তাদের নৌকা করে সরে পড়েছে। এখন সন্ধান নেওয়া যাক, নৌকা কার আর কোথায় গেল;-বসুন এখানে একটু। ঘুরে ঘুরে যথেষ্ট ক্ষুধার উদ্রেকও হয়েছে, আর ত কিছু নাই, এখন এখানে বসে বসে যমুনা হাওয়া খাওয়া যাক।
গোবিন্দ বাবু যমুনার ধারে বসিলেন। আমিও বসিলাম। ক্রমে ধীরে ধীরে পূর্ব-গগনে সূর্যোদয় হইল।
সেই ঘাটে কতকগুলি নৌকা বাঁধা ছিল। ক্রমে বেলা হইলে দাঁড়ী মাঝিরা একে একে আসিয়া নিজ নিজ নৌকায় বসিতে আরম্ভ করিল। যাহারা নৌকায় নিদ্রিত ছিল, তাহারাও উঠিয়া বসিল।
গোবিন্দ বাবু একজন মাঝিকে ডাকিলেন। বলিলেন, বাপু, আমরা নৌকা করে মথুরা যেতে চাই,—কত নেবে?
মাঝি বলিল, নৌকা করে যাবেন, বড় দেরী হবে।
গোবিন্দ। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, যমুনার হাওয়া খেতে যাচ্ছি, না হলে ত রেলেই যেতে পারি।
মাঝি। পাঁচ টাকা দেবেন।
গোবিন্দ। পাঁচ টাকা, বল কি! কাল রাত্রে আমার এক বহু দু টাকায় গেছে যে।
মাঝি। দু টাকায়? কে গেছে।
এই বলিয়া সে আরও দুই-চারিজনকে ডাকিয়া বলিল, বাবুর বলছেন, কাল রাত্রে কে দু টাকায় মথুরায় গেছে। কে গেছে? দু টাকায় কে গেছে রে?
তাহারা সকলে নৌকাগুলি দেখিতে লাগিল। তৎপরে একজন বলিল, দেখছি মঙ্গলুর নৌকা নাই? হয় ত সেই গেছে।
পূর্বোক্ত মাঝি ক্রোধে কহিল, তাকে পঞ্চাতে দিব।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বাপু, যখন একজন গেছে, তখন আমরা তোমাদের বেশী দেব কেন?
মাঝি। দু টাকায় কেউ যায় না। চলুন দেখি, দেখি সে কেমন দুটাকায় গেছে।
সে ক্রোঃ ভরে চলিল। আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। সে সেই খোলর ঘরের দ্বারে আসিয়া মঙ্গলুর স্ত্রীকে ডাকিল। সে বাহির হইয়া আসিলে মাঝি বলিল, মঙ্গলু কোথায় গেছে?
সে বলিল, সে কাল রাত্রে তার নৌকা নিয়ে গেছে।
মাঝি। কার সঙ্গে গেছে?
মঙ্গলুর স্ত্রী। জনিয়ে সঙ্গে গেছে।
মাঝি। ভাড়ায় গেছে কি?
মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ,-একটা কাঠের পা-ওয়ালা লোক সেই নৌকা তাড়া করে নিয়ে গেছে। সে লোকটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারিনে। মাঝে মাঝে এখানে আসত।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তাকে আমরা জানি। তার সঙ্গে একটা খুব ছোট-খাট বেঁটে লোক ছিল,–না?
মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ, সেটাকে দেখলে ভয় করে। ওমা, যেন কেউটে সাপ।
গোবিন্দ। মথুরায় দু টাকার ভাড়া করে গেছে না?
মঙ্গলুর স্ত্রী। তা আমি জানি না।
গোবিন্দ। কবে ফিরবে, তা কিছু বলে গেছে?
মঙ্গলুর স্ত্রী। না।
গোবিন্দ বাবু মাঝির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, দেখলে বাপু, তুমি যখন পাঁচ টাকা চাচ্ছ, তখন আমরা রেলেই যাব।