গোবিন্দ। কেন,ভাই ভাইকে খুন করলে, তার পর ভাই তার পরম ভ্রাতৃস্নেহ ভুলতে না পেরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলে। এতে আর সমস্যার কি আছে!
মহম্মদ। ওঃ—এখন বুঝেছি। এই যে ছাদে গৰ্ত্ত করা। হয়েছে। এই ছেদা দিয়ে উঠে ছাদ দিয়ে নেবে এসে শেষে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দ বাবু, এখনও কি আপনার কোন সন্দেহ আছে?
গোবিন্দ। তার পর লাসের বুকে কাগজ মারা, তাতে উর্দ্দুতে লেখা চারি সাক্ষর।
মহম্মদ। কি মুস্কিল!–এ যে পুলিশের চোখে ধূলা দেবার চেষ্টা, অও আপনি বুঝতে পারূছেন না? বন্ধুর জন্য মানুষে এমন করেও আত্মহারা হয়! জমাদার, বরেন্দ্র বাবুকে এখনই এখানে নিয়ে এস।
জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে তথায় আনিল। মহম্মদ তোগী সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে বলিলেন, মশায়, আপনাকে এই খুনের জন্য আমি গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হলেম।
বরেন্দ্র বাবু কাতর ভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, মহাশয়, আগেই আপনাকে বলেছিলাম।
গোবিন্দ। ভয় নাই,–আমি আপনাকে নির্দোষী সপ্রমাণ কর ভার নিলেম।
মহম্মদ। জমাদার, আসামীকে বাহিরে নিয়ে যাও। দেখ, সাবধান।
বরেন্দ্র। (গোবিন্দ বাবুর প্রতি) মশায়, এ বিপদে আপনি আমাকে দেখবেন।
গোবিন্দ। ভয় নাই।
জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া গেলে মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার কি এখনও সন্দেহ আছে?
গোবিন্দ। ঘোরতর। দাবোগা সাহেব, আপনার অনুসন্ধানের সাহায্য হবে বলে একটা কথা আমি আপনাকে এখন থেকেই বলে রাখি, যে খুন করে জহরতের সিন্দুক নিয়ে পালিয়েছে, সে আপনারই স্বজাতি—মুসলমান,-তার একটা পা কোন রকমে কাটা যায়। তার সে পাটা কাঠের।
মহম্মদ। বলে যান। তার নাম শুদ্ধ বলুন।
গোবিন্দ। তাও বলতে পারি। কিন্তু এখন বলব না। তার সঙ্গে আর একজন সঙ্গী ছিল।
মহম্মদ। বটে?
গোবিন্দ। হাঁ, সে আন্দামান দেশের লোক; এ দেশের মত অম্বা-চওড়া নয়,–ছোট। এ দেশের একটি ছোট ল্যাড়কার মত।
মহম্মদ। (সহাস্যে) বেশ, আর কিছু বলার থাকে—বলে যান।
গোবিন্দ। এখন ঠাট্টা করতে পারেন,–পরে বুঝবেন। আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা যাই।
আমরা উভয়ে তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। দারোগা সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া কোতয়ালীর দিকে রওনা হইলেন। তখন প্রায় ভোর হইয়াছে।
দশম পরিচ্ছেদ।
আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু এখন বাসায় যাইবেন; কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না। তিনি বাড়ীর সম্মুখস্থ বাগানের একখানি বেঞ্চের উপর ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, বসুন। ডাক্তার বাবু।
আমি বলিলাম, আপনি কি এখন বাসায় যাবেন না?
তিনি বলিলেন, এত ব্যস্ত কেন? ঘুম পাচ্ছে নাকি?
আমি। ঘুমের আর অপরাধ কি? সমস্ত রাত্রি জাগরণ।
তিনি। রোদ উঠুক, আর একটু দেখবার দরকার আছে। প্রতিভার কাছে তার কাজের ভার নিয়েছি। আপনি তাকে ভুলে গেলেন নাকি?
হা অদৃষ্ট! আমি তাহাকে ভুলিব! আমি বলিলাম, না, আপনি যতক্ষণ বলবেন, তুতক্ষণ আপনার সঙ্গে থাকতে প্রস্তুত আছি।
তিনি। এ ভাল কথা।
আমি। আপনি দারোগাকে যা যা বললেন তাকি ঠিক?
তিনি। নয় কেন? সহজেই বুঝতে পারা যায়। আপনি আমার দিক্ থেকে দেখলে, ঠিক এমনই বুঝতেন।
আমি। আমার মাথায় কিছুই প্রবেশ করে নাই।
গোবিন্দ। (গম্ভীর ভাবে) হাঁ–এ সহজবোধ্য প্রেমকাহিনী নয়—তদপেক্ষ। এসব অনেক জটিল।
আমি বিরক্ত হইলাম, কোন কথা কহিলাম না।
তিনি বলিলেন, বিরক্ত হবেন না। বুঝিয়ে দিই, দেখুন।
জাবার জন্য আমিও উৎসুক হয়েছি।
একজন এক-পেয়ে লোক, আর একজন খুব ছোট-খাট লোকের সাহায্যে যে এই কাজ করেছে, তা ঘরটা ভাল করে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায়।
তা ত দেখেছি।
এখন চারি সাক্ষরএর কথা ভাবুন। এই চারি সাক্ষর বরে বাবুর পিতার মৃত্যুর পর তার বিছানায় দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও আজ দেখা গেল; আবার প্রতিভার বাপের নিকট সেই চারি সাক্ষর যুক্ত একটা প্ল্যানও ছিল। ইহাতে কি বুঝেন?।
বুঝি এই যে, যে লোক খুন করেছে, তার সঙ্গে প্রতিভার পিতার ও বরেন্দ্র বাবুর পিতার কোন সম্বন্ধ ছিল।
হাঁ, এই সম্বন্ধ কিসের জন্য ছিল, তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেটা কি এই জহরতের সিন্দুক নয়?
এখন ত তাই বলে বোধ হচ্ছে।
তা হলে জানা যাচ্ছে যে, এই দুজন ভলোক এই এক-পেয়ে লোকের কাছ থেকে এই জহরত কোথায় আছে, তা আন্দামানে জানতে পারেন। বরেন্দ্রের পিতা প্রথম ফিরে আসেন। তিনিই জহরত হস্তগত করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেন। প্রতিভার পিতা আন্দামান থেকে ফিরে এসে প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা করেন। দুজনে এই জহরত নিয়ে ঝগড়া হয়। প্রতিভার পিতার সেই সময়ে সেখানে মৃত্যু হয়।
এ সব জানতে পারা গেছে।
ভাল। তার পর আমরা এও জেনেছি, যে এক-পেয়ে বা কাঠের পা-ওয়ালা লোকের উপর বরেন্দ্রের পিতার বড়ই ভয় ছিল; সুতরাং বোঝা গেল যে, এই এক-পেয়ে লোকই প্রথমে জহরতের কথা জান্ত। বরেন্দ্রের পিতা তাকে ফাঁকি দিয়েছিলেন, নতুবা এত ভয় কেন?
এখন বেশ বুঝতে পাছি।
তার পর আন্দামান দ্বীপ থেকে চিঠী পেয়ে তার ব্যায়াম বেড়ে যায়; এতে বোঝা যায় যে, তিনি খবর পান যে, এক-পেয়ে কোন গতিকে আন্দামান থেকে দেশে ফিরেছে। সে তার মরুবার দিন তার জানালায় উঁকি মেরেছিল।
হাঁ, বরেন্দ্র বাবু বলেছিলেন।
বেশ। কাজেই সেদিন সে চারি সাক্ষর লিখে রেখে গিয়েছিল। সুতরাং বোঝা যায় যে, তাকে জহরত থেকে ফাঁকি দেওয়ায় সে প্রতিহিংসা নেবার চেষ্টায় ছিল।