তিনি আমায় দেখিয়া বলিলেন,আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা দুজনে একবার এই ঘরটা ভাল করে দেখি। পুলিশ বাহাদুরেরা যে ভোরের আগে এখানে পদার্পণ করেন—এ বিশ্বাস আমার নাই; তাঁদের কুষ্টিতে তা লেখেও না।
প্রথমেই গোবিন্দ বাবু আমাকে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে বলিলেন। আমি দেখিলাম, মৃতদেহের জামার বুকে একখানি কাগজ অটা, তাহাতে লেখা সেই ভয়াবহ কথা;–
চারি সাক্ষর।
আমি বলিলাম, এ সব কি?
গোবিন্দ। খুন। এইদিকে দেখুন।
দেখিলাম মৃতদেহের ঠিক স্কন্ধের উপর একটি ক্ষুদ্র তীর বিদ্ধ রহিয়াছে। আমি সেটায় হাত দিতে উদ্যত হইলে গোবিন্দ বাবু সচকিতে বলিয়া উঠিলেন, হাত দেবেন না—হাতে দেবেন না, নিশ্চয়ই এটা বিষাক্ত তীর। দেখছেন না, লাসের ভাব?
আমি। হাঁ, নিশ্চয়ই বিষে ইহার মৃত্যু হয়েছে।
গোবিন্দ। এখন দেখা যাক্, কে খুন করেছে।
তিনি গৃহের চারিদিক আমাকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, জানালাও তাই। জানালা দিয়ে কোন রকমে কারই ঘরের ভিতর আসবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু তবুও কোন লোক জানালা দিয়ে উঠেছে; ওই দেখুন তার পায়ের দাগ; আবার এই দেখুন, গোল গোল ছোট ঘোট কাদার দাগ, এক জায়গায় নয়—সমস্ত ঘরময় আছে।
আমি। এ কিসের দাগ?—বোধ হয়, মোটা রকম লাঠীর।
গোবিন্দ। তা নয়, তবে এই দেখুন পায়ের দাগের পাশেই গোল গোল দাগ, কাজেই লোকটার।
আমি বলিয়া উঠিলাম, তবে নিশ্চয়ই একটা কাঠের পা ছিল।
গোবিন্দ। সেই কাঠের পায়ের এক-পেয়ে লোক।
আমি স্তম্ভিত হইলাম।
নবম পরিচ্ছেদ।
গোবিন্দ বাবু কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, বিনা সাহায্যে জানালা খুলে এ ঘরে প্রবেশ করা যায় না, সুতরাং দুজন লোক ছিল।
আমি বলিলাম, তা নিশ্চয়ই।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই এখানে একটা বড় দড়ী পড়ে আছে। কেউ এ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দড়ীটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় দড়ীটা ধরে এই ঘরে এসে, এই লোকটাকে খুন করে। তার পর জহরতের সিন্দুকটা দড়ীতে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তার পর নিজেও দড়ী ধরে নেমে গেছে। এত তাড়াতাড়ি নেমেছে যে, হাতের চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল। এই দেখুন, দড়ীতে রক্তের দাগও রয়েছে।
আমি বলিলাম, কিন্তু কে দড়ী ঝুলিয়ে দিয়েছিল, এখন সেই কথা। সে কেমন করে এই ঘরে প্রবেশ করলে?
ছাদের যে ছিদ্র দিয়ে জহরতের সিন্দুক এই ভদ্রলোক নামিয়ে ছিলেন,—সেই পথেই এক-পেয়ের বন্ধুর আবির্ভাব হয়েছিল।
খুব সম্ভব। আবার আর কোন পথ নাই।
এখন দেখা যাক, ইনি কে, বলিয়া গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া গৃহতল পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; তৎপরে টেবিলের উপর দাড়াইয়া হাতের জোরে ছাতের ছিদ্র দিয়া উপরের চোর-কুটরীতেআসিলেন। আমাকে ইঙ্গিত করায় আমিও সেই রূপে উপরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই চোর-কুটাতে একটি ছোট ঘুলঘুলি আছে। উহার ভিতর দিয়া কোন ছোট বালক বা বালিকা ঘরে সহজে প্রবেশ করিতে পারে।
গোবিন্দ বাবু সেই ঘরের ধূলায় পায়ের দাগ আমাকে দেখাইলেন। আমি বলিয়া উঠিলাম, এ যে খুব ছোট ছেলের পায়ের দাগ। কি ভয়ানক।
গোবিন্দ বাবু মন্তকান্দোলন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ভয়ানক কিছুই নয় ডাক্তার বাবু,ভয়ানক কিছুই নয়; সংসারে সবুই সম্ভব। পরে দেখতে পাবেন। এই বালক বা বামন কোন রকমে ছাদে ছাদে এসে চোর-কুটরী হয়ে এ ছিদ্রের মধ্য দিয়ে এই ঘরে এসেছি। তার পর সে দড়ী ঝুলিয়ে দেয়, সেই দড়ী ধরে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় এই ঘরে উঠে এসে কাজ হাসিল করে যান।
এখন তাই স্পষ্ট বোধ হচ্ছে।
এক পেয়ে লোকই ঢারি সাক্ষর লিখে গিয়েছে, সুতরাং এই এক-পেয়েকে দেখে এই ভদ্র লোকের গুণবা পিতা মরবার সময় ভয় পেয়েছিলেন।
এখন আমার স্মরণ হচ্ছে।
প্রতিভার পিতাও এই চারি সাক্ষরের মধ্যে ছিলেন, না হলে তিনি কেন এই চারি সাক্ষর যুক্ত প্ল্যান নিজের ঠিকানায় আন্দামান হতে পাঠাবেন?
হাঁ, তা নিশ্চয়।
এখন এই পর্যন্ত। এই যে আমাদের পুলিশ দেখা দিয়েছেন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।
এই সময়ে কোতোয়ালীর দাবোগা মহম্মদ তোগী সাহেব, জন কয়েক কনেষ্টবল সহ বরেন্দ্র বাবুর সহিত তথায় উপস্থিত হইলেন। আমরা দুইজনে সরিয়া দাঁড়াইলাম।
কিন্তু গোবিন্দ বাবুকে ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত পুলিশ কর্মচারীই চিনিতেন। তিনি গোবিন্দ বাবুকে দেখিয়াই চিনিলেন। বললেন, আপনি। আপনি যে এখানে?
গোবিন্দ। বরেন্দ্র বাবু আমার বন্ধু, কাজেই এসে পড়েছি।
মহম্মদ। ইনিই কি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন?
গোবিন্দ। হাঁ।
মহম্মদ। কি বুঝছেন? বরেন্দ্র বাবু একটু ঐদিকে যান।
তিনি ইঙ্গিত করায় কনেষ্টবলের বরেন্দ্র বাবুর সঙ্গে সঙ্গে গেল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কিছুই এখন বুঝি নাই।
মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
গোবিন্দ। কি বুঝলেন?
মহম্মদ। কি আশ্চর্য! আপনার মত লোকও কোন বন্ধু বিপাকে পড়লে সে বিষয়ে আর কিছুই বুঝতে পারেন না।
গোবিন্দ। কি করি—আমি ত কিছুই বুঝতে পাছি না।
মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বুঝতে পারা যাচ্ছে। বরেন্দ্র বাবুটি ভাইকে মেরে জহরতের সিন্দুকটা সরিয়ে এখন নেকা সেজে পুলিশে খবর দিয়েছেন।
গোবিন্দ। আর লাস দাদার উপর দয়া করে, উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে আছেন। ভ্রাতৃ স্নেহের এমন নিদর্শন এ জগতে বড়ই দুর্ল্লভ—তোগী সাহেব বড়ই, দুর্ল্লভ।