গোবিন্দ। দেখছি আপনি বড় সহৃদয়। প্রতিভা নিশ্চয়ই আপনার নিকট চির-বাধিত থাকবে। তার পর সে গুপ্ত ধনের সন্ধান আপনারা কি কিছু পেয়েছেন?
বরেন্দ্র। সেই কথাই ত হচ্ছে।
গোবিন্দ। বলুন, আমরা শোনবার জন্য উৎসুক আছি।
বরেন্দ্র। আমি ধনের কথা একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার ভাইটি সে ছেলে নয়। সে তন্ন তন্ন করে বাড়ী খুঁজে শেষ ছাদের উপর একটা ছোট চোর-কুরীতে বার করে। নীচের দিকে ছাদ খুড়লে সে জহরতের সিন্দুক দেখতে পায়। তার পর নীচে নাবিয়ে নিয়ে আসে।
গোবিন্দ। তার পর?
বরেন্দ্র। তার পর আমি বলি, দেখ এর অর্ধেক আমাদের নয়। আমরা বাবার মৃত্যুশয্যায় শপথ করেছি, মনোহর বাবুর মেয়েকে অর্ধেক দিব। এতে আর দেরী করা আমাদের ভাল নয়। সে বলে, এ ধন আমি খুঁজে বার করেছি, এর এক পয়সাও কাকেও দিব না। এই নিয়ে আমাদের দুজনের ভারি ঝগড়া হয়। তার পর আমি বিরক্ত হয়ে বাড়ী ছেড়ে এসে এখানে এই বাড়ী ভাড়া করে আছি।
গোবিন্দ। আপনি মহৎ লোক।
বরেন্দ্র। না—এতে মহত্ত্বের বিশেষ কিছু নাই। বাবার মরবার সময় শপথ করেছিলাম। যেমন করে হয়, একে তার অর্ধেক দিব।
গোবিন্দ। এ জহরতের দাম কত হতে পারে?
বরেন্দ্র। ভায়া আন্দাজ করেন ক্রোড় টাকার উপর। বাবাও তাই বলেছিলেন।
গোবিন্দ। তিনি এ জহরত কোথায় পেয়েছিলেন, তা কিছু আপনি জানেন?
বরেন্দ্র। কিছুই না।
গোবিন্দ। এখন কি করতে চান?
বরেন্দ্র। এখন আপনারা এসেছেন। এখনই তার সঙ্গে দেখা কব। এখন ভয়ে দেবে।
সেই রাত্রেই তার সঙ্গে দেখা করা স্থির হইল। প্রায় রাত্রি এগারটার সময় আমরা চারি জনে তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
অনেক ঠেলাঠেলির পর একজন চাকর আসিয়া দরজা খুলিয়া। দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, ব্যাটারা সব মরে আছে? ছছাট বাবু কোথায় রে?
চাকর। হুজুর, ছোট বাবু তার ঘরে আছেন।
বরেন্দ্র। চল্ ব্যাটা, আলো দেখিয়ে চল্।
আমরা সকলে উপরে চলিলান। বরেন্দ্র বাবু অগ্রে অগ্রে যাইতে ছিলেন,—তিনি একটা ঘরের দ্বারে আসিয়া ধাক্কা মারিলেন। দ্বার রুদ্ধ। তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আর ত কোন কাজ নাই, এখন ভায়া আমার প্রত্যহ রাত্রে দরজা দিয়ে জহরতের ফন্দ করেন আর দাম কসেন। বেশী করে ধাক্কা মাতে হল দেখছি।
কিন্তু দ্বারে পুনঃ পুনঃ ধাক্কা দিতেও কেহ দ্বার খুলিল না—কোন উত্তর দিল না। তখন বরেন্দ্র বাবু দরজার একটা ছিদ্র দিয়া গৃহের ভিতর কি হইতেছে, দেখিতে চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু তিনি সহসা এমনই চীৎকার করিয়া পশ্চাৎ পদ হইলেন যে, আমরা সকলেই চমকিত হইয়া উঠিলাম। গোবিন্দ বাবু অগ্রসর হইয়াছিলেন,—ছিদ্রে চক্ষু দিলেন, তৎপরে বলিলেন, দরজা ভাঙতে হবে।
তাহার শরীরে অসীম বল। কবটের উপরে পৃষ্ঠ স্থাপন করিয়া তিনি এমনই বল প্রয়োগ করিলেন যে, মহা শব্দে দরজা ভাঙিয়া গেল।পরক্ষণে যে দৃশ্য সম্মুখে দেখিলাম, তাহাতে আমার শিরায় শিরায় শোণিত ছুটিল। প্রতিভা মূর্চ্ছিত হইয়া ভূপতিত হইতেছিল, আমি তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম।
দেখিলাম, এক ব্যক্তি চেয়ারে বসিয়া আছে। তাহার দেহ অসাড় নিস্পন্দ, নিশ্চয়ই বহুক্ষণ তাহার মৃত্যু হইয়াছে। তাহার চেহারা ও বরেন্দ্র বাবুর চেহারা এমনই এক যে, আমি প্রথমে ভীত ও স্তম্ভিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম। তিনিও শুন্তিতভাবে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিলেন।
সহসা বরেন্দ্র বাবু বলিয়া উঠিলেন, কে এমন সৰ্ব্বনাশ করে গেল! নরেনের মন ভাল ছিল না বটে, একটু লোভী, কিন্তু সে এদিকে লোক বড় ভাল ছিল! কে এমন সৰ্ব্বনাশ করিল। তৎপরে তিনি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, মশায় দেখুন, অরতের সিন্দুকটাও চুরি করে নিয়ে গেছে।
বরেন্দ্র বাবু বংশপত্রের ন্যায় কঁপিতে ছিলেন। কঁপিতে ঝাপিতে অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, আপনারা জানেন, আমি এর কিছুই। জানি না। কিন্তু এখন পুলিশে কি তা শুনবে? তারা ভাববে আমিই ধনেয়, লোভ নিজের ভাইকে খুন করেছি?
গোবিন্দ বাবু তাহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, প্রতিভাকে এখানে রাখা আর উচিত নয়; আপনি একে এর বাড়ী পৌছাইয়া আসুন। সেই গাড়ীতেই আপনি যেন এখন এখানে ফেরেন।
আমি বলিলাম, এখনই আসিতেছি।
গোবিন্দ বাবু তখন বরেন্দ্র বাবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, যদি বাঁচতে চান, তবে আপনিও এদের গাড়ীতে কোতোয়ালীতে এখনই যান, সেখানে গিয়ে খুনের খবর দিন। তাদের তদন্তে এখন আপনি সাহায্য না করলে তারা আপনাকে আরও সন্দেহ করবে।
বরেন্দ্র বাবু কম্পিত কলেবরে বলিলেন, আপনি যা বলবেন, তাই কব। আপনি আমাকে এ বিপদে রক্ষা করুন।
গোবিন্দ। যান, এখনই যান।
আমি অর্ধ-মূর্চ্ছিতা প্রতিভাকে ক্রোড়ে করিয়া লইয়া গাড়ীতে উঠিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বরেন্দ্র বাবুও আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন। তাহাকে কোতোয়ালীতে নামাইয়া দিয়া আমরা প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম।
আমি নানারূপে প্রতিভাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। ভয়ে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায় প্রতিভা প্রায় আমার বুকের ভিতর লুকাইয়াছিল। আমি বলিলাম, প্রতিভা, তোমার কি ভয় করছে?
প্রতিভা বলিল, না, আপনার কাছে থাকলে আমার ভয় করে না।
তাহার পর আমরা দুজনে কত কথা কহিলাম। কি কহিলাম, তাহা এখন আমার মনে নাই। তবে এইটুকু আমার বেশ মনে আছে যে, আমি বড়ই সুখে ও বিমল আনন্দে সে সময়টা কাটাইয়াছিলাম। আমি প্রতিভাকে নামাইয়া সেই গাড়ীতেই আবার সত্বর আসিয়া গোবিন্দ বাবুর সহিত মিলিলাম। দেখিলাম, তিনি গৃহটি বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছেন। তখনও পুলিশের কেহ আসে নাই।