গোবিন্দ। তা ত দেখতে পাচ্ছি।
বরেন্দ্র। আমার ভায়ের বাড়ী দেখলে আরও বুঝবেন। যা সে কথা, কিন্তু তিনি সুখী হতে পারেন নাই। সকল সময়েই যেন কিসের ভয়ে চম্কে চমকে উঠতেন। বিশেষতঃ কাঠের পা-ওয়ালা লোকের ওপর তার বড় ভয় ছিল। সকল সময়েই চাকরদের বলতেন,সাবধান, এ রকম লোক যেন বাড়ীতে না ঢুকতে পায়।
এমন সময়ে ভৃত্য তামাক আনিয়া গোবিন্দ বাবুকে দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, তামাক খান, মহাশয়।
গোবিন্দ বলিলেন, হুঁ খাচ্ছি–তার পরে?
বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, বছর দুই আগে সহসা আন্দামা থেকে এক চিঠী পেয়ে তার ব্যাম বড় বেড়ে পড়ল। তিনি একদিন আমাদের দুজনকে ডেকে গোপনে বলেন, দেখ আমার আর বড় দেরী নাই, কিন্তু আমি মহাপাপী, আমার বন্ধুর ধনও আমি চুরি করেছি,আহা তার অনাথা কন্যার উপর বড় অবিচার করেছি। যে ধন তার পাওয়া উচিত ছিল, তার এক পয়সাও তাকে দিই নাই। বলে একছড়া বহুমূল্য মুক্তার মালা বার করে আমাদের দেখিয়ে বলেন, এই দেখ এই মুক্তার হার—তাকে পাঠিয়ে দেব বলে বার করেছিলাম, কিন্তু এমন লোভী আমি,এমনই পাপী আমি যে, প্রাণ ধরে দিতে পারি নাই? যে রকমে হক আমরা দুজনে প্রায় ক্রোড় টাকার জহরত পাই। আন্দামান হতে ফিরেই মনোহর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, কিন্তু—এই বলে বাবা মূর্চ্ছিতপ্রায় হলেন, তার বাবোধ হল, আমরা তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকৃতে ছুটলেম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বরেন্দ্রনাথ বাবু পুনরায় বলিতে লাগিলেন, ঘণ্টাখানেকের পর তিনি আবার কতকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তখন সকলকে বিদায় করে দিয়ে আমাদের দুজনের হাত ধরে বললেন, দেখ আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। আমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ কর যে, সেই ধনের অর্ধেক মনোহরের মেয়েকে দিবে। আমরা উভয়ে শপথ করলাম। তখন তিনি অতি কষ্টে বলতে লাগলেন, আমি ভগবানের নামে মৃত্যু সময়ে শপথ করে বছি যে, আমি মনোহরকে খুন করি নাই। সে এলে এই ধনের ভাগ নিয়ে আমাদের দুজনে বচসা হয়, সহসা মনোহর মূৰ্জিত হয়ে পড়ে যায়। আমি তাড়া তাড়ি তাকে তুলতে গিয়ে দেখি, তার মৃত্যু হয়েছে। আমি জানতেম, তারহৃদরোগ ছিল। হঠাৎ রাগ হওয়ায় মৃত্যু ঘটেছে।
পিতার মৃত্যু সংবাদ পাইয়া প্রতিভা আকুল হইয়া কঁদিয়া উঠিল। আমি নানারূপে তাহাকে সান্ত্বনা করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। এই পিতৃশোক-কাতরা পরারুদ্যমানাকে কিরূপে আমি সান্ত্বনা করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তাহার হাত দুখানি আমার হাতে লইলাম। সেই সকরুণ দৃশ্যে আমারও চক্ষুদ্বয় অপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কি কঠিন-হৃদয় গোবিন্দ বাবু! তাহার চক্ষু সম্পূর্ণ নিরশ্রু। অষ্টম বর্ষীয় বালক যেমন আগ্রহপূর্ণ নত্রে বিচিত্রগল্পকারী মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, গোবিন্দ বাবু ঠিক তেমনই ভাবে বরেন্দ্র বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তারপর?
বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, ভয়ে আমার সর্ব শরীর কাপতে লাগল। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই আমাকে খুনী পুলিশে ধবে। তখন আমার বিশ্বাসী চাকরকে ডেকে সেই গভীর রাত্রে আমরা দুজনে মনোহরের সেই মৃতদেহ মাটির নীচে পুতে ফেলেম। ও কে—কি ভয়ানক! কে আছ—রক্ষা কর—রক্ষা কর–বলে সহসা বাবা জানালার দিকে চেয়ে ভয়ানক চীৎকার করে উঠলেন। আমরা দেখলেম, একটা দাড়ীওয়ালা বিকট মুখ জানালা দিয়া উঁকি মারূছে। আমরা ছুটে বাহিরে গেলাম, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি, বাবার মৃত্যু হয়েছে।
বরেন্দ্র বাবু পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া চোখের জল মুছিলেন। তাহার পর নীরবে তামাক টানিতে লাগিলেন।
গোবিন্দ বাবু কি ভাবিলেন জানি না। আমি কিন্তু, বরেন্দ্র বাবু নীরব হওয়ায় বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম। আমি নানারূপে সান্ত্বনা করিয়া প্রতিভাকে কতকটা প্রকৃতিস্থ করিলাম। কিন্তু গোবিন্দ বাবু পাষাণ হতেও পাষাণ, তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করুলেন, তার পর? যেন এখনই সবটা না শুনিলে তাহার সর্বনাশ হইবে।
বরেন্দ্র বাবু, শটকার নল পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, মনোহর বাবুর মৃত্যুর পর বাবা কাশীর বাড়ী ছেড়ে আগ্রায় বেলেন-বাজারে এসে বাস করেন। আমরা দু-ভাইও তার সঙ্গে ছিলাম। এইখানেই ঝবার মৃত্যু হয়। তাহার সৎকার করে এসে দেখি, বাবার যে ঘরে মৃত্যু হয়েছে, সেই ঘরের সব জিনিষ কে ওলট-পালট করেছে, কিন্তু কিছু চুরি করে নাই। তবে দেখলেন, তার বিছানার ওপর কে এক থানা কাগজ রেখে গেছে; তাতে উর্দ্দুতে লেখা;
চারি সাক্ষর।
গোবিন্দ বাবু বলিয়া উঠিলেন, আমিও ভেবেছিলাম তাই।
আমরা সকলেই বিস্মিত-হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, তিনি সে বিষয়ে লক্ষ্য না করিয়া বলিলেন, হাঁ, তার পর?
বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, বাবার মুখে এই গুপ্ত ধনের কথা আমরা শুনেছিলাম, আমরা কাশীর বাড়ী আর এখানকার আগ্রার বাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেম, কিন্তু কোন সন্ধানই পেলেন না। তখন যদিও আমার ভাই কিছুতেই রাজী হল না,তবুও আমি সেই মুক্তার হার একে দিতে প্রতিজ্ঞা করলেম। একে সহজ ভাবে দিলেকে কি বলে অথবা ইনি নেন কি না নেন, এই ভেবে আমি কাগজে এর ঠিকানার জন্য বিজ্ঞাপন দিলেম।
গোবিন্দ। তা আমরা জানি।
বরেন্দ্র। এঁর ঠিকানা পাবার পর একেবারে হারটা পাঠিয়ে দিলে পাছে কে কি সন্দেহ করে, এই ভেবে দুমাস অন্তর এক-একটা মুক্ত পাঠিয়ে দিতে লাগলেম!