এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু পার্শেলের মোড়কের হাতের লেখা এবং পত্রের লেখা বিশেষ রূপে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন,তৎপরে বলিলেন, যদিও পত্রের লেখা একটু বাঁকিয়ে লেখা হয়েছে, তবুও এই দুই লেখা যে একই ব্যক্তির, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। যা হক, কাল সন্ধ্যার পরই আমরা আস্ব। ঠিক হয়ে থেক।
প্রতিভা ঘাড় নাড়িল। আমরা আচাৰ্য মহাশয়ের নিকটে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম।
পথে গোবিন্দ বাবু একটি কথাও কহিলেন না। বাসায় আসিয়া বলিলেন, এই মেয়ের বাপকে তারই পরম বন্ধু গোমস্তা মশায় খুন করেছেন।
শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। বললাম, বলেন কি?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পরে দেখিবেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
পর দিবস সন্ধ্যার পরেই আমরা প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। দেখিলাম, প্রতিভা প্রস্তুত হইয়া আছে।
আমরা উপস্থিত হইলে প্রতিভা বলিল, কাল আপনাদের একটা বিষয় দেখাতে আমি ভুলে গেছলেম।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি?
প্রতিভা একখানা রেজিষ্টারী পত্ৰ গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। রেজিষ্টারী পত্ৰখানি ভোলা ছিল। গোবিন্দ বাবু পত্রখানি বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
প্রতিভা বলিল, বাবার যে দিন পৌঁছিবার কথা ছিল, ঠিক সেই দিন এই রেজিষ্টারী পত্ৰ তার নামে আসে। আমি সই করিয়া নিই। তার পর তিনি ফিরে না আসায় আমিই খুলেছিলাম।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন,এটা দেখছি, একটা বড় বাড়ীর রাফ, প্ল্যান, দেশী কাগজে আঁকা। অনেক ঘর, বারান্দা, উঠান আছে। এক জায় গায় একটা লাল কালির চিহ্ন আছে, তার ঠিক উপরে লেখা চার দিক হতে ৩৭ ফুট। নীচে উতে লেখা চারি সাক্ষর। তার পর ভিন্ন ভিন্ন হস্তাক্ষরে চারিটা নাম—আবদুল, দোস্ত মহম্মদ, হাজারিমল, কুমার সিং। এটা একটা দরকারী কাগজ সন্দেহ নাই, বলিয়া তিনি পত্রখানি যত্নে নিজ পকেটে রখিলেন। তৎপরে বলিলেন, আমাদের একটু আগে যাওয়া উচিত।
একখানা গাড়ী আনা হইল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। আমরা শীঘ্রই তাজমহলে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু সেখানে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।
ঠিক নয়টার সময় একজন আমাদের নিকটে আসিয়া বলিল, আপনার নাম কি প্রতিভা দেবী? প্রতিভা হ, বলিলে সেই ব্যক্তি বলিল, এরা দুজন?
প্রতিভা। আমার আত্মীয়।
লোক। পুলিশ নয়?
প্রতিভা। না—দুজন লোক সঙ্গে যাবার কথা আছে।
লোক। জানি,—আসুন।
আমরা রাস্তায় আসিয়া দেখিলাম, একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। আমরা তিন জনে গাড়ীতে উঠিলে, সেই ব্যক্তি গাড়ীর কোচবাক্সে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া চলিল। গাড়ী যে যে রাস্তা দিয়া চলিল, গোবিন্দ বাবু তাহা বিশেষ লক্ষ্য করিতে লাগিলেন।
নানা রাস্তা দিয়া গাড়ী চলিল। এই রূপে অৰ্দ্ধ ঘণ্টা চলিয়া একটি বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বালুগঞ্জ-জহর মলের বাড়ী।
গোবিন্দ বাবুর অবিদিত স্থান জগতে ছিল কি না সন্দেহ।
******
কোচম্যান নামিয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল। আমরা তিন। অনে নামিলাম। দেখিলাম, বাড়ীটি বেশ সুসজ্জিত। প্রকোষ্ঠ পর প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিতে করিতে আমরা একটি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম।
একটি বাঙ্গালী যুবক অগ্রবর্তী হইয়া বলিলেন, প্রতিভা দেবী?
প্রতিভা ঘাড় নাড়িলেন।
তখন তিনি বলিলেন, আমার নাম বরেন্দ্র নাথ দাস সরকার। হরিহর সরকার মহাশয়ের পুত্র-যমজ পুত্র। আমার এক যমজ ভাই আছে, তার নাম নরেন্দ্র নাথ সরকার। আমার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুর আপনার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুরের এক সময়ে বিশেষ বন্ধু ছিলেন। এ দুটি ভদ্রলোক কে?
প্রতিভা সলজ্জভাবে কহিলেন, আমার আত্মীয়।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার নাম গোবিন্দরাম আদিত্য-ইনি ডাক্তার বসু।
বরেন্দ্র। বেশ-বেশ, খুব ভাল। তাই বলছিলাম, এঁর পিতা ঠাকুর নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
গোবিন্দ। তা আমরা জানি।
বরেন্দ্র। সব জানেন না মহাশয়—সব জানেন না।
গোবিন্দ। কতক কতক জানি-জানি তিনি আপনাদের বাড়ীতে খুন বা গুম হয়েছেন।
প্রতিভা বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিল।
বরেন্দ্রে বাবু বলিলেন, দেখছি আপনি কতক কতক জানেন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কতক কতক কেন, সব জানি।
বরেন্দ্র। বলুন–বলুন।
গোবিন্দ। জানি, আপনার পিতা তাকে খুন করেছেন।
এই অভূতপূর্ব কথা শুনিয়া প্রতিভা চমকিত হইয়া উঠিল। আমার বোধ হইল,যেন সে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে, কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে প্রতিস্থা হইল। তাহার চক্ষু দুটী অশ্রুজলে ভরিয়া উঠিল।
গোবিন্দ বাবু এরূপ ভাবে এ কথা প্রতিভার সম্মুখে বলায় তার উপর আমার বড়ই রাগ হইল; অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলাম। কিন্তু অনাথা প্রতিভার কষ্টে আমার বড় কষ্ট হইতে লাগিল।
বরেন্দ্র বাবু হাসিয়া বলিলেন, মহাশয়, তামাক খান,—আপনি কিছুই জানেন না। ওরে তামাক দে।
তাঁহার কথায় প্রতিভার ভগ্ন হৃদয় একটু আশ্বস্ত হইল। ব্যাকুল নেত্রে তাহার দিকে সে চাহিল।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তবে আপনিই বলুন। আমি শুনিতে থাকি।
বরেন্দ্র। তাই ত বলতেই যাচ্ছিলাম—আপনি বাধা দেন কেন? গো
বিন্দ। বলুন।
বরেন্দ্র। বাবাও কমিসরিয়েটের গোমস্তাগিরী কাজে আন্দামানে যান। বছর দুই আগে তিনি হঠাৎ ফিরে আসেন; এসেই কাজ ছেড়ে দেন। উদরাময় রোগে তিনি অনেক দিন হতে ভুগছিলেন। তিনি অনেক টাকা রোজগার করেছিলেন; তার কোন অভাব ছিল না। অনেক টাকাও রেখে গেছেন।