প্রতিভার পিতা নিরুদ্দেশ হইলে তাহার টাকা বন্ধ হইয়াছিল। এখন আচার্য্য মহাশয় তাহাকে নিতান্ত অনাথা দেখিয়া দয়া করিয়া গৃহে রাখিয়াছিলেন। তাহার পিতার সন্ধানের জন্য নিতান্ত যত্ন পাইতেছিলেন।
আমরা প্রথমে আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাদের উভয়কে বিশেষ সমাদর করিলেন। গোবিন্দ বাবুকে বলিলেন, আপনার প্রশংসা শুনে প্রতিভাকে আপনার আশ্রয় নিতে বলেছিলাম। আপনি তার পিতার বাল্য-বন্ধু। আপনি এই দুর্ভাগিনী বালিকার উপকার কলে, আমরা সকলেই আপনার চির ৰাধিত থাকব।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
তিনি বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি প্রতিভাকে এখানে আছি। তাহার মুখে শুলে আপনি সবই বুঝতে পারবেন।
তিনি উঠিয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে এক পরম রূপবতী যোড়শী যুবতী সেই গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। তাহার অপরূপ রূপে গৃহ যেন প্রদ্যোতিত হইয়া উঠিল।
আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, এই আপনার বাল্যবন্ধুর কন্যা প্রতিভা। তৎপরে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন,ইনিই স্বনামখ্যাত গোবিন্দ বাবু—আর ইনি ইহার বিশেষ বন্ধু, ডাক্তার বসু।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তোমার পত্র পেয়ে কতক জানতে পেরেছি। কিন্তু তোমাকে আমার আরও কিছু জিজ্ঞাসা কবার আছে।
প্রতিভা বলিল, আপনি দয়া করে এসেছেন, এতে যে কত অনুগৃহীত হয়েছি তা
গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) সে সব কথা এখন থাক,অনুগ্রহ-নিগ্রহের কথা পরে হবে। এখন যা জিজ্ঞাসা করি, তাই বল।
প্রতিভা। বলুন।
গোবিন্দ বাবু প্রতিভার সহিত এরূপ রূঢ়ভাবে কথা কহিতেছেন দেখিয়া, আমি বিশেষ দুঃখিত হইলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
প্রতিভা ধীরে ধীরে এক পার্শ্বে আসিয়া বসিল। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বলিলেন, কোন তারিখে তোমার বাবা নিরুদ্দেশ হন, সে সম্বন্ধে তুমি কি জান?
প্রতিভা বলিল, দু বৎসর হল, কার্তিক মাসের পনেরই তারিখে বা তাঁর এখানে পৌছিবার কথা। সেই পৰ্যন্ত নিরুদ্দেশ।
তিনি পথে কোন্খানে নামবেন, বলেছিলেন?
হাঁ । লিখেছিলেন, যদি পারেন কাশী হয়ে আসবেন?
কেন? সেখানে কি তার কোন বন্ধু আছেন?
একজন ছিলেন। তিনি তাঁর বিশেষ বন্ধু শুনেছিলাম।
তার নাম?
হরিহর সরকার।
ইনি কি কাজ করতেন?
তিনি কমিশরিয়েটের গোমস্তা ছিলেন। শুনেছি, অনেক টাকা রোজগার করেছেন।
তার কাছে কোন সন্ধান নেওয়া হয়েছে?
প্রতিভা আচার্য্য মহাশয়ের দিকে চাহিল। তিনি বলিলেন, হাঁ, আমি নিজে কাশী গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।
গোবিন্দ। তিনি কি বলেন?
আচাৰ্য। তিনি বলেন, কই মনোহর বাবু ত কাশী আসেন নাই। আসিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতেন।
গোবিন্দ। তার পর আর কিছু সন্ধান করেছিলেন?
আচাৰ্য। হাঁ, কোন সন্ধান পাই নাই।
গোবিন্দ। তিনি এখন কোথায়? আচাৰ্য। এক বৎসর হল মারা গেছেন। গোবিন্দ বাবু প্রতিভার দিকে চাহিয়া বলিলেন,তার পর।
প্রতিভা। এক বৎসর হল খবরের কাগজে আমার ঠিকানার জন্য কে একজন বিজ্ঞাপন দেন।
গোবিন্দ। যিনি বিজ্ঞাপন দেন, তার কোন ঠিকানা ছিল?
প্রতিভা। না, কেবল লেখা ছিল, ডাক্তার মনোহর কর, যিনি আন্দামানে চাকরী করিতেন, তাহার কন্যা এই সংবাদপত্রে তিনি এখন কোথায় জানাইলে, তাহার বিশেষ উপকার হইতে পারে।
গোবিন্দ। এই বিজ্ঞাপনের পর তোমার ঠিকানা কি কোন কাগজে ছাপান হয়?
আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, হাঁ, আমি ঠিকানা কাগজে ছাপাই।
গোবিন্দ। এই হরিহর বাবুর মৃত্যুর কতদিন পরে বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তা কি জানেন?
আচাৰ্য। বোধ হয়, মাস দেড়েক পরে।
আবার গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তার পর কি কিছু ঘটেছিল?
প্রতিভা। হাঁ, তার পর প্রতি দু মাস অন্তর পার্শেল ডাকে এক একটা মুক্তা আমার নামে এসেছে। এই দেখুন।
এই বলিয়া প্রতিভা একটি বাক্স খুলিল। আমরা দেখিলাম, পাচটা বহু মূল্যবান্ মুক্তা তাহার ভিতর রহিয়াছে।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পার্শেলের উপরের মোড়কগুলা আছে?
প্রতিভা। হাঁ, আছে। এই দেখুন।
গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া পার্শেলের মোক গুলি দেখিলেন, তৎপরে বলিলেন, তার পর আর কিছু হয়েছে?
প্রতিভা। এই চিঠী পেয়েছি।
প্রতিভা একখানি পত্র গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। আমরা পড়িলাম;
১৭ই তারিখে রাত ৯টার সময় তাজমহলের পশ্চিমদিকে থাকিয়ে। তোমার উপর যে অন্যায় ব্যবহার হইয়াছে,তাহার প্রতিকার করিব। যদি অবিশ্বাস হয়,কি ভয় হয়, তোমার দুইজন আত্মীয় বা শুভানু ধ্যায়ীকে সঙ্গে আনিয়ে। পুলিশের লোক আনিয়ো না, তাহা হইলে কাহারও দেখা পাইবে না। তোমারও কোন উপকার হইবে না।
গোবিন্দ বাবু পত্র ও খাম উভয়ই বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিলেন। তৎপরে আচাৰ্য মহাশয়কে বলিলেন, আপনি নিশ্চয় এর সঙ্গে যাচ্ছেন?
আচাৰ্য। আমি বুড়ো মানুষ,-আমাকে কেন? এখন যা করতে হয়, আপনি অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক করুন।
গোবিন্দ। এর যাওয়া নিতান্ত দরকার। দুইজন বন্ধু সঙ্গে নিতে বলেছে। আমি যাইব, আর আমার বন্ধুও আশা করি যাইবেন।
প্রতিভা আমার দিকে চাহিল।
আমি বলিলাম, আপনারা যদি বলেন, অবশ্যই যাইব।
গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে বলিলেন, আশা করি, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার কোন ভয় হইবে না।
প্রতিভা সলজ্জভাবে বলিল, আপনাদের সঙ্গে আমার যেতে ভয় কি? আপনি আমার পিতার বন্ধু।
গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, তুমি যথার্থই আমার বন্ধুর উপযুক্তা কন্যা। আজ থেকে আমি তোমার পিতৃস্থানীয়।