গোবিন্দ। স্থির হয়ে শুনুন। শুলেই বুঝতে পাবেন।
আমি। আমায় বুঝিয়ে দিন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
গোবিন্দ। আমি প্রথমে বলি, আপনার ভাই বড় অসাবধানী ছিলেন। ঘড়ীটা কত জায়গায় টোল খেয়েছে, ইহাতে কত জিনিষের দাগ রয়েছে,–যে লোক ভাল দামী রূপার ঘড়ী এমন অসাবধানে রাখতে পারে, সে লোক যে নিতান্ত অসাবধানী—তা বলা কি বড় কঠিন?
আমি কেবল ঘাড় নাড়িলাম। তিনি বলিলেন, তার পর ভিতর দিকার ডালায় চাটে দাগ আছে। মাড়োয়ারীদের কাছে কোন জিনিষ বাঁধা রাখলে, তারা এই রকম দাগ দেয়। এতে জালেম, আপনার ভাই চারবার এই ঘড়ী বাধা দিয়েছিলেন। এতে কি বোৰা যায় না যে, সময়ে সময়ে তার টাকার বড়ই অভাব হয়েছিল। আরও বছি যে, সময়ে সময়ে তার অবস্থা ভাল হয়েছিল, তা না হলে ঘড়ী খালাস করবেন কেমন করে?
আমি কি বলিব; নীরব হইয়া রহিলাম।
তখন তিনি বলিলেন,ঘড়ীর দম দিবার জায়গায় ভাল করে দেখুন। চাবী দিবার স্থানের চারিদিকে কত চাবীর আঁচড়ের দাগ পড়েছে। মাতাল না হলে ঘড়ীতে দম দিবার সময় তাহার এত হাত কাঁপে বা তিনি দম দেবার স্থান খুঁজিয়া পান না! যে লোক এত মদ খেত,তার তাতেই মৃত্যু হয়েছে বলা শক্ত নয়। এখন কি, এরূপ বলা শক্ত বলে মনে করেন? তাহার পর আরও দেখুন, ঘড়ীর উপর নীচে পিঠেও চাবীর গোচ্ছ, যা-তা আরও কত কি পূরেছেন-এ সকল লক্ষণ মাতালেই।
আমি বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আমাকে মাপ করুন,আমি আপনাকে চিনতে পারি নাই। বোধ হয় কেহই পারে নাই। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক।
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া সেতার তুলিয়া লইয়া বলিলেন, এখন একটা বেহাগ শুনুন।
কিন্তু এই সময়ে ডাকওয়ালা আসিয়া তাহার হাতে একখানি পত্র দিল। তিনি পত্রের খামখানি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া অবশেষে
অতি সাবধানে পত্রখানি খুলিলেন।
বিশেষ মনোযোগের সহিত পত্রখানি পাঠ করিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন; তৎপরে পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
আমি পত্রখানি পড়িলাম,
শ্রদ্ধাস্পদেযু–
কোন আত্মীয়ের নিকটে শুনিলাম, আপনি আমার পিতার সহপাঠী ও এক সময়ের বিশেষ বন্ধু। আমি শ্ৰীযুক্ত মনোহর কর মহাশয়ের একমাত্র কন্যা। আমার পিতা বহুকাল আগ্রায় বাস করেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন; পরে আগ্রা হইতে বলী হইয়া আন্দামানে যান। তিনি ব্রাহ্ম, আমাকে ব্রাহ্ম-বালি-বিদ্যালয়ে রাখিয়া যান। পূর্বে আমার মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমার পিতা ব্রাক্ষ বলিয়া, আত্মীয়-স্বজনের সহিত তাহার সম্ভাব ছিল না।
তিনি যখন আন্দামানে যান, তখন আমার বয়স বার-তের বৎসর। দুই বৎসর তাহার রীতিমত পত্র পাইয়াছিলাম; মাসে মাসে টাকাও পাঠাইতেন। তাহার পর একদিন তাহার পত্রে জানিলাম, তিনি দেশে আসিতেছেন। কিন্তু দুই বৎসর গেল, তাহার আর কোন সংবাদ নাই। তাঁহার যে কি হইল, অদ্যাপি তাহার কিছুই জানিতে পারিলাম না।
আমাদের আচাৰ্য মহাশয়ের নিকট আপনার প্রশংসা শুনিলাম। আপনি যে আমার পিতার বাল্যবন্ধু তাহাও শুনিলাম। আজ অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র লিখিতেছি। আপনি এই অনাথ পিতৃমাতৃহীনা বালিকার প্রতি এ দুঃসময়ে দয়া না করিলে, কে করিবে? আমি জানি, আপনি চেষ্টা করিলে নিশ্চয়ই আমার পিতার অনুসন্ধান হইবে।
যদি দয়া করিয়া একবার এখানে আসেন, তবে অন্যান্য সকল কথা জানাইতে পারি। আশা করি, অনুগ্ৰহ করিয়া আসিবেন। ইতি–
আপনার কন্যা
শ্ৰীমতী প্রতিভা দাসী।
আমি পত্র পাঠ করিয়া বলিলাম, কি করবেন?
গোবিন্দ। তাই ভাবছি।
আমি। এ রকম উপকার করা কর্ত্তব্য। এ নিরুদ্দেশ ভদ্র লোকের যদি কেউ সন্ধান করতে পারেন, তবে আপনিই পাবেন।
গোবিন্দ। আপনি এ কথা বিশ্বাস করেন?
আমি। যদি কেউ পারে, আপনিই পাবেন।
গোবিন্দ। এখন ত কিছুই জানি না।
আমি। এইজন্য এই বালিকার সঙ্গে আপনার দেখা করা কর্তব্য।
গোবিন্দ। আপনি যাবেন?
আমি গোবিন্দ বাবুর প্রশ্নে একটু বিস্মিত হইলাম। বলিলাম, আমি! আমি গিয়া কি করিব?
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আমার আর একটা ওস্তাদী দেখিতে পাইবেন।
আমি একটু ভাবিয়া বলিলাম, আমার এখানে থাকাও যা, আগ্রায় থাকাও তাই। আর একটা চেঞ্জও হবে, তাতে আরও উপকার হতে পারে।
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আরও একটা উপকার হতে পারে; আপনি এখনও বিবাহ করেন নাই, এই প্রতিভাকে বিবাহ করুন না কেন?
আমি। আপনি ক্ষেপিলেন দেখছি। কোথায় এই বালিকা তার নিরুদ্দেশ পিতার জন্য দিন রাত কেঁদে মছে, আপনার শরণাপন্ন হয়েছে, আপনি কোথায় তার পিতার সন্ধান কবেন, না তার বিবাহ নিয়ে উপহাস করছেন।
গোবিন্দ। উপহাস নয়। ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে?
আমি সে কথা চাপা দিয়া বলিলাম, তবে কবে যাওয়া স্থির কলেন?
গোবিন্দ। আপনি কবে যেতে চান?
আমি। আমাকে যখন বলবেন, তখনই প্রস্তুত আছি।
গোবিন্দ। তবে শুভস্য শীঘ্রং। আজই—এখনই।
আমি। বেশ।
আমরা তখনই আগ্রা যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। রাত্রের গাড়ীতে রওনা হওয়াই স্থির হইল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমরা আগ্রায় আসিয়া ব্রাহ্ম-বালিকাবিদ্যালয়ের সন্ধানে চলিলাম। সেটা প্রকৃত বিদ্যালয় নহে। এখানে যিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের কাৰ্য্য করিতেন, তিনি তাহার পরিবার মধ্যে একটি ছোট বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। চার পাঁচটির অধিক ছাত্রী ছিল না। তাহার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায়, তিনি কয়েকটি বালিকাকে গৃহে থাকিতে দেওয়ায় তাহার অর্থের কিছু সহায়তা হইত। তাহার স্ত্রী বিদুষী ছিলেন; তিনিই শিক্ষয়িত্রীর কাজ করিতেন।