আমি। যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ ধরে রাখতে পারা যায়, তা হলে মানুষের রক্তের দাগ যত দিনেরই হউক না, তা অবশ্যই ঐ জলীয় ভাগ ঐ দাগে দিলে নিশ্চয়ই জানতে পারা যেতে পারে।
দেখুন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু একখানা রুমাল তুলিয়া ধরিলেন। দেখিলাম, তাহাতে রক্তের দাগের মত খানিকটা দাগ লাগিয়া আছে।
পরে তিনি এই দেখুন, বলিয়া একখানি ছুরি নিজের একটা অঙ্গুলীতে অম্লানবদনে বসাইয়া দিলেন। ঝর ঝক্ করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। তিনি সেই রক্ত একটা কাচের পাত্রে ধরিলেন। উহা হইতে একটা কাচের নল আর একটা কাচ-পাত্রে গিয়াছে। তিনি তখন যে পাত্রে রক্ত ছিল, উহার নীচে একটা বাতি জ্বালিয়া ধরিলেন। রক্ত হইতে ধূম নির্গত হইয়া নল দিয়া অপর কাচ-পাত্রে যাইতে লাগিল। তিনি ঐ কাচ-পাত্রের গায়ে শীতল জল দিতে লাগিলেন। তখন ঐ ধূমে ঠাণ্ডা লাগায় কাচ-পাত্রে জলে পরিণত হইতে লাগিল।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই যে জল হল, এ জল কি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ নয়?
আমি। নিশ্চয়। এ জল অন্য কিছুর জলীয় ভাগ হতেই পারে না।
গোবিন্দ। আচ্ছা, এখন এই জল রুমালের রক্তের দাগে লাগাইয়া দেখা যাক্।
তিনি সেই জল ধীরে ধীরে রুমালের রক্তের দাগের উপর লাগাইতে লাগিলেন। আমি স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, ঐ বহুকালের অস্পষ্ট দাগগুলি টাটকা রক্তের দাগ হইয়া পড়িল। বোধ হইল, যেন এইমাত্র কে ইহাতে রক্ত লাগাইয়া দিয়াছে।
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, এখন কেউ কি বল্তে পারে যে, রুমালে মানুষের রক্তের দাগ ছিল না?
আমি। কারও সাধ্য নাই। আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।
গোবিন্দ। তা হক আর নাই হক। এটা আগে আবিষ্কার হলে, যে সকল দুবৃত্ত খুনী এখনও নিশ্চিন্ত মনে পরের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে, তারা ফাঁসী-কাঠে তাদের উপযুক্ত দণ্ড ইত।
আমি। নিশ্চয়ই। আমি অনেক কেস জানি, যে রক্তের দাগ
গোবিন্দ। আমি এখন ভাবছি, এ আবিষ্কার দেখে রাম সিং, সূরযমল এণ্ড কোং কি বলবে?
আমি। যা আপনার নূতন হাতকড়ী দেখে বলেছিল।
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া খুব উৎসাহের সহিত তাহার প্রিয় সেতার তুলিয়া লইলেন। বহুক্ষণ মনের আনন্দে সেতার বাজাইতে লাগিলেন। আমি নীরবে তাহার মধুর সেতারে গৌরারং শুনিতে লাগিলাম।
প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে তিনি সহসা থামিলেন। বলিলেন, আপনি সেদিন না আমাকে কি জিজ্ঞাসা করবেন, বলেছিলেন?
আমি বলিলাম, , আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বলেন যে এমন কি, কোন মানুষের ব্যবহারের জিনিষ দেখে আপনি সেই লোকের অনেক বিষয় বলে দিতে পারেন।
গোবিন্দ। কতকটা নিশ্চয় পারি বই কি।
আমি। এই ঘড়ীটা দেখে বলুন দেখি।
আমি তখনই আমার পকেট হইতে একটা পুরাতন রূপার ঘড়ী তাহার হাতে দিলাম। তিনি সেটি লইয়া বহুক্ষণ একমনে নাড়া-চাড়া করিতে লাগিলেন। আমি নীরবে বসিয়া রহিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আপনি এই ঘড়ীর ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের বিষয় কিছু জাতে চান? কিন্তু এই ঘড়ী আপনার হাতে আসায় আপনি একে অয়েল করিয়েছেন, সাফ করিয়েছেন, সুতরাং ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের অনেক চিহ্ন লোপ পেয়েছে।
আমি বলিলাম, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ঘড়ীটী পেয়ে যথার্থই অয়েল করিয়েছিলাম।
তিনি বলিলেন, তবুও আমি কিছু কিছু বলার চেষ্টা করব। এই ঘড়ীটা আপনার দাদার ছিল। তিনি এটা আপনার পিতার মৃত্যুর পর পান।
আমি হাসিয়া বলিলাম, ঘড়ীর পিছনে বি, সি, বি খোদা আছে দেখে এটা আপনি আন্দাজ করেছেন।
গোবিন্দ। আপনি ঠিক বলেছেন। বি তে বসু, কাজেই আপ নারই কেহ। ঘড়ীর উপরের তারিখে জানা যায়, এটা প্রায় পঞ্চাশ ষাট বৎসরের আগেকার তৈয়ারী। খোদাই অক্ষর তিনটিও সেই রকম পুরাণ। সুতরাং বুঝিলাম, ঘড়ীটা আপনার পিতার ছিল। ঠিক নয় কি?
আমি। হাঁ, তাই ঠিক।
গোবিন্দ। তার পর আপনি বলেন আপনি ঘড়ীটা পেয়েই অয়েল করেছেন। অয়েল বেশী দিনের নয়, কাজেই বোঝা যায়, আপনি ঘড়ীটা বেশী দিন পান নাই।
আমি। তাও ঠিক।
গোবিন্দ। সাধারণতঃ বাপের ঘড়ী-টড়ী বড় ছেলেই পেয়ে থাকে। আপনার কাছে শুনেছি, আপনার পিতা অনেক দিন স্বর্গারোহণ করে ছেন; সুতরাং তার মৃত্যুর পর ঘড়ীটা আপনার বড় ভাই পাতার পর আপনি পেয়েছেন। এই কি ঠিক নয়?
আমি। হাঁ।
গোবিন্দ। ভাল। তার পর আপনার বড় ভাই বড়ই অসাবধানী ছিলেন। তাহার পৃথিবীতে যশঃ মান ধন হবার কথা ছিল। কিন্তু স্বভাবের দোষে কখন তাহার অবস্থা ভাল ছিল, কখনও তিনি বড়ই কষ্টে পড়িয়াছিলেন। শেষে মদ খেয়ে তাহার মৃত্যু হয়। এই পর্যন্ত এই ঘড়ী দেখে জাতে পাছি।
আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আপনি কোন রকমে আমার অভাগা ভাইএর জীবনের সন্ধান জেনে এখন সেই কথা বলে আমাকে কষ্ট দিতে চান। এটা কি ভাল? আপনি কি বলতে চান যে, আপনি এই পুরণ ঘড়ী দেখেই এই সব জানতে পেরেছেন?
গোবিন্দ বাবু, আমার হাত ধরিয়া সাদরে আমাকে বসাইলেন। বলিলেন, ডাক্তার বাবু, আপনার প্রাণে যদি কোন কষ্ট দিয়া থাকি, তবে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, অন্য কথা কি,আপনি আমার হাতে এই ঘড়ী দিবার পূর্বে আমি যথার্থই জানতেম না যে, আপনার কোন ভাই ছিলেন।
আমি বলিলাম, তবে আপনি কেমন করে এ সব কথা জানলেন? এ সমস্তই ঠিক কথা।