আমি আস্তে আস্তে দরজায় হাত দিয়া দেখি, দরজা খোলা। আমি তিলার্ধ দেরী না করিয়া সত্বর তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া একেবারে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। পাণ্ডুরাং লক্ষ দিয়া উঠিয়া বসিল। আমি বলিলাম, চেঁচাইও না, তা হলে কুকুর শিয়ালের ন্যায় মারিব। এই মাত্র বালকিষণকে খুন করে এসেছি।
পাওরাং চীৎকার করিতে যাইতে ছিল আমার কথায় সে ভয় পাইয়া নীরব রহিল। তাহার মুখ হইতে কোন শব্দ নির্গত হইল না, কেবল বলিল, মিথ্যা কথা।
আমি বলিলাম, মিথ্যা কথা আমি বলি না—সে অভ্যাসও আমার নাই। তোরও সময় উপস্থিত। কুকুর শিয়ালের মত মাব না, এই বড়ী বাছাই করে খা।
আমি বালকিষণকে যাহা বলিয়াছিলাম, ইহাকেও তাহা বলিলাম। তাহার দিকে বড়ীর কৌটাটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলাম; কিন্তু পর মুহূর্তেই পাণ্ডুরাং ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় আমার উপরে পড়িল। আমি পড়িয়া গেলাম, সে আমার উপরে পড়িল। সে এমনই বলে আমার গলা টিপিয়া ধরিল যে, আমার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। আমি তখন অতি কষ্টে আমার কাপড়ের ভিতর হইতে আমার ছুরিখানা বাহির করিয়া তাহার হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ করিলাম। যখন আমি ছুরি টানিয়া লইলাম, তখন সেই সঙ্গে পাণ্ডুরাংএরও প্রাণ বাহির হইয়া গেল। আমি তাহারই রক্তে দেয়ালে লিখিলাম, সাজা।
তাহার পর তাহারই লোটার জলে হাত ধুইয়া, তারই বিছানায় ছুরি পুছিয়া নিঃশব্দে সত্বর মোসাফের-খানা হইতে বাহির হইলাম। —তখন প্রায় ভোর হইয়াছে। লোকজন তখনও উঠে নাই। আমি আমার এক্কা লইয়া বাসায় আসিলাম।
পরদিন খুনের কথা সহময় রাষ্ট্র হইল, আমিও শুনিলাম। তখনই লাহোর ছাড়িয়া যাইবার ইচ্ছা হইল,—কিন্তু ভাবিলাম, পুলিশ চারিদিকে লোক রাখিয়াছে। এখন হঠাৎ আমি যদি লাহোর হইতে চলে যেতে চাই, তা হলে আমার উপরই তাদের সন্দেহ হবে। তাহার উপর ইয়ারিং ফেলে লাহোর ছাড়িয়া যাইতে আমার মন চাহিল না।
আবার ভাবিলাম, আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? কিসের জন্য জীবনের মায়া! কাহার জন্য আর বাঁচিয়া থাকিব! কেন নিজেই পুলিশে গিয়ে সব কথা স্বীকার করি না? কিন্তু ফাঁসী—ফসীকাঠে ঝুলিয়া মরা, তাহা কখনই হইবে না।
এই সকল ভাবনায় আবার আমার নাক মুখ দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িল। আমি নিজে স্পষ্ট বুঝিলাম যে, আমার জীবনের আর অধিক বিলম্ব নাই, সুতরাং ইচ্ছা করিয়া কেন পুলিশের হাতে যাই।
পরদিন কাগজে ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞাপন দেখিয়া, বুড়ী সাজিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিলাম। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, আমার সে ইয়ারিং নয়। তখন আমি বুঝিতে পারিলাম যে, আমাকে ধরিবার চেষ্টা হইতেছে। কতকটা সন্দেহ হইল মাত্র; কিন্তু ভাবিলাম, বোধ হয় আর কেহ ইয়ারিং রাস্তায় ফেলে গিয়ে থাকবে। কারণ ডাক্তার বাবুর সঙ্গে পুলিশের সম্বন্ধ কি?
তাহার পর একটা ছোঁড়া আসিয়া আমাকে ভাড়ার জন্য ডাকিল। ভাড়ায় না গেলে পাছে কেহ সন্দেহ করে বলিয়া আমি এক্কা লইয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। তাহার পর যাহা যাহা হইয়াছে, আপনারা সকলই জানেন।
গোবিন্দ বাবু না হইলে পুলিশের সাধ্য ছিল না যে, আমাকে ধরে। আর দুচার দিন হইলে আমি দেশে ফিরিতে পারিতাম।
আবার সেই রক্ত,-হাত পা কঁপিতেছে, আমার সময় শেষ হইয়া আসিয়াছে,—রক্ত আর থামে না। আমি খুনী নই। ভগবান পাপীর দণ্ড দিয়াছেন,—আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হইয়াছে। পাপীর সাজা হইয়াছে,-আমি এখন বড়ই সুখী। চলিলাম, স্বর্গে আমার চন্দনের সহিত মিলিতে চলিলাম। চন্দন–
৩য় খণ্ড – ডাক্তার বসুর কথা
তৃতীয় খণ্ড।
(ডাক্তার বসুর কথা।)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
সেটী-মহল্লার ব্যাপার চুকিয়া গেলে গোবিন্দ বাবু কয়েক দিন মৌন ভাবাপন্ন হইলেন। নানা কারণে আমার শরীরও খারাপ হইয়া পড়ি; এইরূপে কয়েক দিন কাটিল।
একদিন দেখিলাম, তিনি তাহার শিশি-বোতল লইয়া বড়ই কাত রহিয়াছেন। তিনি কি করিতেছেন, তাহাই আমি আরাম কেদার অৰ্ধশায়িত অবস্থায় এক দৃষ্টে লক্ষ্য করিতেছিলাম। সহসা তিনি লক্ষ দিয়া উঠিয়া বঁড়াইলেন, আমিও উঠিয়া বসিলাম।, তিনি বলিলেন, ডাক্তার বাবু, এত দিনে আমার পরিশ্রম সার্থক
হল। আমি এক নূতন জিনিষ আবিষ্কার করেছি।
আমি বলিলাম, কি?
তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, এতদিন রক্ত পরীক্ষা করিবার ঠিক উপায় ছিল না। রক্তের দাগ পুরাতন হলে সেটা মানুষের রক্তের দাগ বা অন্য জানোয়রের রক্তের দাগ কি কোন ফলের রসের দাগ, তা ঠিক কবার উপায় ছিল না। অণুবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে কতক কতক বুঝা যেত বটে, কিন্তু ঠিক হত না।
আমি। তা ঠিক, আমাকে পুলিশ-চালানী অনেক রক্তের দাগ পরীক্ষা করতে হয়েছে, কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও ঠিক বলতে পারি নাই। আপনি কি আবিষ্কার করেছেন?
গোবিন্দ। আপনি ত জানেন যে, রক্তে দুটা জিনিষ আছে, একটা জলীয় ভাগ আর একটা রক্তের ভাগ। রৌদ্রে শীঘ্রই জলীয় ভাগটা উড়ে যায়, কেবল রক্তের ভাগটাতেই দাগ থাকে।
আমি। তা ত নিশ্চয়।
গোবিন্দ। কিন্তু মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ আর জানোয়ারের রক্তের বা অন্য কিছুর জলীয় ভাগ এক নয়।
আমি। এ ত সকলেই স্বীকার করবে।
গোবিন্দ। তবে কোন উপায়ে যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ শিশিতে ধরিয়া রাখা যায়, তবে কোন রক্তের দাগের মত চিহ্ন দেখিলে ঐ জল একটু ঐ দাগের উপর ঢালিয়া দিলেই সেটা মানুষের রক্তের দাগ কিনা তখনই জানতে পারা যাবে। নয় কি?