আমি বলিলাম, কিছু না,আমিও খাই।
গোবিন্দ। ভাল। সব আগে বলা ভাল। আমার মাঝে মাঝে একটা রোগ আছে। মৌনী হয়ে যাই। তখন কারও সঙ্গে কথা কই না। ক্রমে দুই চার দিনে আবার ঠিক হয়ে আসি।
আমি। আমারও যে এ রোগ নাই, তা নয়; তবে রোগটা এক সময়ে দুজনের হলেই বড় ভাল হয়।
গোবিন্দ। বেশ, খুব ভাল। আরও একটা কথা, আমার কাছে রং-বেরংয়ের লোক আসে, তাতে আপনার কোন আপত্তি আছে?
আমি। আপনার কাছে আসিবে, তাতে আমার আপত্তির কারণ কি?
গোবিন্দ। আমি মাঝে মাঝে সেতার বাজাই। বাদ্যি-বাজনা পছন্দ করেন?
আমি। সুমিষ্ট বাজনা, বিশেষতঃ সেতার, কে না পছন্দ করে?
গোবিন্দ। ভাল খন আপনার বিষয় বলিতে পারেন।
আমি লোকটি কথাবার্তায় বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম। বলিলাম, দেখিতেছেন ত আমার শরীর। শরীর শোধরাইবার জন্যই দিন-কতক লাহোরে থাকা, একটু নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলেই হইল।
তিনি বলিলেন, পোষাবে। তৎপরে মহেশ্বর প্রসাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, চলুন, এখন বাড়ীটা একবার দেখা যাক।
আমরা তিন জনে একখানি এক্কা ভাড়া করিয়া সহরের এক প্রান্তে, আসিলাম। তথায় মহেশ্বর প্রসাদ একটী ছোট বাড়ীতে আমাদের লইয়া গেলেন। বাড়ীটি বেশ, চারিদিক খোলা, সামনে একটু বাগানও ছিল। আমাদের উভয়েরই বাড়ীটি বেশ পছন্দ হইল। আমরা সেইদিনেই তথায় আসিব, স্থির করিলাম।
সন্ধ্যার পূর্বেই আমাদের জিনিষপত্র লইয়া আমরা সেই বাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। মহেশ্বর বাবু, পাচক ও ভৃত্য স্থির করিয়া দিলেন।
মহেশ্বর বাবু বিদায় হইবার সময় আমি তাঁহার সঙ্গে রাস্তা পর্য্যন্ত আসিলাম; তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবুকে বুঝিলে?
আমি বলিলাম, না, ক্ৰমে বুঝিব।
তিনি আবার হাসিয়া বলিলেন, তুমি বুঝিতে পার আর না পার, উনি তোমাকে এক ঘণ্টাতেই বুঝিয়া লইবেন। লোকটা বড়ই ক্ষমতাপন্ন।
আমি বলিলাম, তাত কতক বুঝিতেছি। ইনি কি কাজ-কর্ম করেন, জান?
ক্রমে জাতে পাবে। বলিয়া তিনি হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
প্রথমে গোবিন্দ বাবুর সঙ্গে বসবাস করা পোষাইবে কি না, এ সম্বন্ধে আমার একটু ভাবনা হইয়াছিল, কিন্তু কয়েক দিন একত্রে থাকায় দেখিলাম যে, তাঁহার সহিত বাসে কোনরূপ অসুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। যখন তিনি বাসায় থাকিতেন, তখন তাঁহার শিশি বোতল, কাগজ-পত্র, বই লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন। আহারাদির পর প্রায়ই বাহির হইয়া যাইতেন। রাত্রে কোন কোন দিন আমার সহিত কথোপকথন করিতেন, কোন দিন বা তিনি আমাকে তাঁহার প্রিয় সেতার শুনাইতেন। দেখিলাম, তিনি সুন্দর সেতার বাজাইতে পারেন।
প্রথমে আমি ভাবিয়াছিলাম, আমারও যেমন এখানে কোন বন্ধুবান্ধব নাই, বোধ হয় ইহারও তাহাই; কিন্তু ক্রমে দেখিলাম, তাহা নহে। এক দিন একজন পুলিসের ইনস্পেক্টর তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন; আর এক দিন সূরযমল বলিয়া একটি ভদ্রলোক আসিলেন। পূর্বে যে তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে তাহার নিকট রং-বেরংয়ের লোক আসে, এখন দেখিলাম তাহা সত্যই। প্রায় প্রত্যহই তাহার নিকট রকমের নানা লোক আসিতে লাগিল। তিনি তাহাদের সহিত গোপনে কথা-বার্তা কহিতেন। কি কথা হইত, তাহা আমি জানিতে পারিতাম না। জানিবার ইচ্ছা করা অন্যায় বিবেচনা করিয়া আমি কখনও সে বিষয়ে উৎসুকও হই নাই। তিনি কি কাজ কর্ম করেন, তাহাও তাহাকে কখনও জিজ্ঞাসা করি নাই। ভাবিলাম, তিনি নিজেই একদিন কথায় কথায় বলিয়া ফেলিবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না।
একদিন দেখিলাম, একখানা পাওনিয়র কাগজ তাহার পার্শ্বে পড়িয়া আছে। একটা প্রবন্ধের পার্শ্বে লালকালীর দাগ দেওয়া রহিয়াছে; দেখিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। দেখিলাম, প্রবন্ধটির নাম জীবন-পৰ্যবেক্ষণ। নূতন নাম দেখিয়া একটু বিশেষ আগ্রহে সহিত পড়িতে লাগিলাম। পড়িয়া কিন্তু সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না। একজন লোক আশে পাশের সকল বিষয় বিশেষরূপে দেখিলে যে কত দূর শিক্ষা লাভ করিতে পারেন, তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইয়াছে। লেখক বলেন, চেষ্টা করিলে যে-কেহ অপরের চক্ষু দেখিয়া, মুখের ভাব দেখিয়া, তাহার হাবভাব বুঝিয়া, অনায়াসে সেই লোকের হৃদয়ের অন্তস্তম প্রদেশের কথাও জানিতে পারেন। এরূপ লোকে নিকট কিছু গোঁন করা বা মনের ভাব লুকাইয়া রাখা বা কোন রূপ প্রতারণা করা অসম্ভব। লেখক বলেন–
যেমন চিন্তাশীল নৈয়ায়িক এক ফোঁটা জল দেখিয়া অদৃষ্টপূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের অস্তিত্ব অনায়াসে স্থির করিতে পারেন, সেইরূপ যে ব্যক্তি সকল বিষয় বিশিষ্টরূপে দেখেন, তিনি মনুষ্য জীবনের সকল কথাই অনায়াসে অবগত হইতে পারেন। তবে এ বিদ্যা শিক্ষা বিশেষ পরিশ্রন সাধ্য। ইহা শিক্ষার জন্য আশে-পাশের লোকদিগকে বিশেষরূপে দেখা আবশ্যক। সকল বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন। এইরূপে চেষ্টা করিলে সকলেই একজন লোককে দেখিয়া অনায়াসেই তিনি কি কাজ করেন, তাহার মনের কথা কি, তাহা বলিয়া দিতে পারেন–ইত্যাদি।
আমি কাগজখানা ফেলিয়া দিয়া বলিলাম, বলা সহজ, করা শক্ত। এ যদি হত, তাহা হলে জগতের অনেক দুঃখ ঘুচিত।
গোবিন্দ বাবুর কর্ণে সে কথা প্রবেশ করিবামাত্র তিনি আমার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিলেন, ব্যাপার কি?
আমি বলিলাম, এই প্রবন্ধটা দেখিতেছি আপনিও পড়িয়াছেন; কেবল পড়া নয়,দাগ দিয়াও রাখিয়াছেন। ঘরে চেয়ারে বসিয়া এ রকম লেখা সহজ, কিন্তু কাজে করাই শক্ত। আমার এ বিশ্বাসই হয় না। এই লেখককে যদি ভীড়ের সময়ে একখানা থার্ডক্লাস রেল গাড়ীর ভিতর বসাইয়া বলি, বাপুহে, বল দেখি, যে এই সকল লোকের কার কি ব্যবসা? কার কি মনের ভাব? যদি কেউ তা ঠিক বলতে পারে, তা হলে আমি তার কাছে সেই মুহূর্তে হাজার টাকা হাতে প্রস্তুত আছি।