ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
প্রায় আধঘণ্টা পরে সেই বাড়ীর ভিতর একটা গোলযোগের শব্দ পাই লাম। বুঝিলাম, দুই ব্যক্তিতে খুব মারামারি হইতেছে। পরে দেখি লাম, একব্যক্তি বালকিষকে গলা ধাক্কা দিতে দিতে সদর দরজার কাছে আনিল,-তৎপরে তাহার পিঠে সবলে এক পদাঘাত করিল, বালকিষণ রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল গেল, কিন্তু তখনই উঠিল। তখন সেই ব্যক্তি এক প্রকাণ্ড লাঠী লইয়া তাহাকে তাড়া করিল। বালকিষণ টলিতে টলিতে ছুটিল, নিকটে আমার একা দেখিয়া তাহাতে উঠিয়া বসিয়া বলিল, জদি হাঁকাও। আমিও বায়ুবেগে আমার এক্কা হাঁকাইলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, সে প্রায় নিদ্রিত হইয়াছে। এত দিন পরে পাপাত্মাকে হাতে পাইয়াছি ভাবিয়া, আমার প্রাণে যে কি আনন্দ হইল, তা বলা যায় না। আমি এই দুরাত্মাকে কোথায় গিয়া ইহার সমুচিত দণ্ড দিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।
সহসা সেটী-মহল্লার খালি বাড়ীটা আমার সম্মুখে পড়িল। আমি এক্কা থামাইলাম। বাড়ীর দরজায় এক্কা দাড় করাইয়া এক্কা হইতে নামিলাম। বালকিষণকে ধাক্কা দিয়া তুলিলাম। সে বলিল, এটা ষ্টেশন?
আমি বলিলাম, হাঁ।
আমি তাহাকে ধরিয়া লইয়া সেই খালি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সে বলিয়া উঠিল, কি বাবা, আজ আলো নাই কেন?
আমি বলিলাম, ভয় নাই,আলো জ্বলছি।
আমার পকেটে বাতি ও দেশলাই ছিল, আমি আলো জ্বালিলাম, তৎপরে তাহার মুখের উপর আলো ধরিয়া বলিলাম, বালকিষণ রাও, আমাকে চিনতে পার?
সে আমার স্বরে স্তম্ভিত হইল, বলিল,কে তুমি?
আমার তখন শিরায় শিরায় আগুন ছুটিয়াছে। আমি বলিলাম, আমি ত্রিম্বক রাও–চন্দন বাঈয়ের স্বামী। মনে পড়ে?
এই কথা শুনিয়া সে আমার দিকে বিস্ফারিত নয়নে চাহিল,–বোধ হইল, যেন এক নিমেষে তাহার সমস্ত নেশা ছুটিয়া গেল, তাহার সর্বাঙ্গ কপিতে লাগিল, সে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আমার দিকে চাহিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিল, মা তুমি—তবে কি আমাকে খুন কবে?
আমি বলিলাম, নিশ্চয়। তবে কুকুর শিয়ালের ন্যায় তোক মারব। যে কথা আগে তোকে বলেছিলাম, এখনও তাই বছি। এই কৌটায় দুটা বড়ী আছে, একটা বিষের বড়ী, খেলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু আর একটায় বিষ নাই,খেলে কিছুই হবে না। তুমি একটা খাও,আমিও একটা খাব। দেখি ভগবানের রাজত্বে ন্যায় বিচার আছে কি না।
ভীতিবিহ্বল বালকিষণ যুক্ত করে বলিল,দয়া কর,ক্ষমা কর—এবার আমায় রক্ষা কর—প্রাণ ভিক্ষা দাও।
আমার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ ছুটিতেছে, আমি বলিলাম, দয়-ক্ষমা তোকে দয়া-ক্ষম—কিছুতেই নয়,—অসম্ভব। গুণবন্ত রাওকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল নরাধম! তার স্ত্রীকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল পাষণ্ড?
বালকিষণ। আমি খুন করি নাই।
আমি। তোর হুকুমে যে কাজ হয়েছে, সে তোরই কাজ। আমার চন্দন বাঈকে যখন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল? দয়া! খা, এই বড়ী এখনি।
এই বলিয়া আমি আমার বস্ত্রের ভিতর হইতে এক শাণিত ছুরি বাহির করিয়া তাহার মাথার উপরে তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, বৃথা সময় নষ্ট আমি করি না,—খা বড়ী—যেটা ইচ্ছা হয় খা,-না হলে এই ছুরিতে কুকুর শিয়ালের মত তোকে মারব।
সে বংশপত্রের মত কাঁপিতে লাগিল। অবশেষে কম্পিত হস্তে কৌটা হইতে একটা বড়ী তুলিয়া লইয়া মুখে দিল,আমিও অন্যটা গিলিয়া ফেলিলাম। এক মিনিট খাইতে-না-খাইতে সে ভূমিসাৎ হইল, তাহার মুখ হইতে একটা কথাও বাহির হইল না। আমি তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিলাম, তার মৃত্যু হইয়াছে। এই উত্তে জনায় একদিন নাসিকে যেরূপ আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িয়াছিল, আজও তেমনই হইল। রক্ত দেখিয়া আমার মনে একটা খেয়াল হইল। আমি তখনই আমার আঙ্গুল আমারই রক্তে ডুবাইয়া দেয়ালে লিখিলাম,–সাজা। কিন্তু এখন শুনিতেছি, সাজার আকার স্পষ্ট লিখিতে পারি নাই। তাড়াতাড়িতে কি লিখিলাম, ভাল করিয়া দেখি নাই।
তখন আমি সত্বর বাহিরে আসিয়া এক্কায় উঠিলাম। কিছু দূর আসিয়া কাপড়ের ভিতর হাত দিয়া দেখি, ইয়ারিংটি নাই। আমার চন্দনের ইয়ারিং, আজীবন যে ইহা আমি বুকে বুকে রাখিব তাহার নিকট প্রতিশ্রুত আছি! আমি একা ছাড়িয়া আবার সেই বাড়ীর দিকে চলিলাম। দেখি, বাড়ীতে তখন কনেষ্টবল আসিয়াছে, তাহারা আমাকে দেখিতে পাইয়াছে,তখন মাতালের ভাণ করিয়া মাতলামী করা তাহারা আমার দিকে আর দৃষ্টিপাত করিল না। আমি হতাশ হইয়া এক্কায় আসিয়া উঠিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
তখন আমার সর্ব শরীরে বিদ্যুৎ ছুটিতেছিল। একজনের দণ্ড দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু এখনও পাপিষ্ঠ পাণ্ডুরাং বাকী। আমি সত্বর ষ্টেশনের দিকে চলিলাম। তথায় অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, অনেকক্ষণ সে বালকিযণের জন্য অপেক্ষা করিয়া, সে আসিল না দেখিয়া মসাফের-থানায় গিয়া বাসা লইয়াছে। আমি তখনই মাফের-খানার দিকে চলিলাম।
তখন সেখানে সকলেই ঘুমাইয়াছিল। কেবল দেখিলাম, একটা ঘর হইতে আলো দেখা যাইতেছে। আমি সেই ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, পাণ্ডুয়াংই সেই ঘরে আছে। সে তখনও ঘুমায় নাই, একখানা বই লইয়া পড়িতেছে; আমার পায়ের শব্দে সে দরজার দিকে চাহিল। বোধ হয়, বালকিষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। তাহারই। ভাবনায় ঘুমাইতে পারে নাই।