আমিও কাল আপনাকে কাগজ গুলো দিব। কোন গতিকে কেউ না টের পায়, বালকিষণের বিছানায় রেখে দিবেন।
তাই হবে।
তিনি বিদায় হইলেন। আমিও একটা বাসা ঠিক করিবার চেষ্টায় চলিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
নাসিকে বাসা পাওয়া শক্ত নয়। বাসা ঠিক করিয়া আমি কাগজ কলম দোয়াত কিনিলাম। পর দিন রাত্রে গঙ্গাধর রাওকে ত্রিশখানি কাগজ দিলাম। তাহাতে লিখিয়াছিলাম;–
বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং!
তোমাদের পাপের দণ্ড দিব। আজ হতে এক মাস সময় দিলাম। যদি সাহস থাকে, এক মাসের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা কবে, হয় তোমরা মরবে, না হয় আমি মরব। আর যদি দেখা না কর, তবে কুকুর-শেয়ালের মত খুন করে মারব। আজ থেকে ত্রিশ দিন সময়।
পরের খানায় লিখিলাম,আজ থেকে ২৯ দিন সময়। তার পর ২৮ দিন সময়। ২৭ দিন সময়। এই রকম শিখানা। গঙ্গাধর কাগজগুলি লইয়া গেলেন। আমি বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে রহিলাম ।
দিনের পর দিন বালকিষণ আমার কাগজ পাইতে লাগিল। কোথা হইতে কে তাহার বিছানায় এই কাগজ রাখিয়া যায় জানিতে না পারিয়া, সে বড়ই ভীত হইয়া পড়িল, তাহার আহার নিদ্রা গেল। আমি এই সংবাদ পাইয়া প্রাণে বড়ই আনন্দ উপলব্ধি করিলাম।
সে টাকা দিয়া পুলিশকে হাত করিল। আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিল। পুলিশ একদিন আমাকে ধরিল, আমিও পুলিশকে বলিলাম, সর্দার বালকিষণ আমার স্ত্রী ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে। পুলিশ আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিল, আমাকে বলিল, শীঘ্র এ সহর থেকে পালাও,না হলে জেলে দিব। আমি অগত্যা দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়া রহিলাম। এই সময় হইতে ছদ্মবেশ ধরিতে আরম্ভ করিলাম। এ বিদ্যায় কতদূর পাকা হইয়াছি তা—গোবিন্দ বাবু তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।
আমার ভয়ে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ক্রমে অস্থির হ উঠিল। ক্রমে যতই কাগজের দিন কম হইয়া আসিতে লাগিল, তত তাহার। উন্মত্তের ন্যায় হইল, শেষে দুজনে নাসিক ছাড়িয়া পন। কিন্তু পালাইবে কোথায়—পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আন তাহাদের অনুসরণ করিতে প্রস্তুত।
আমি এ সংবাদ পাইয়া তাহাদের সঙ্গ লইলাম। তাহারা আমার। হাত এড়াইবার জন্য কলিকাতায় গেল, আমিও কলিকাতায় আসিলাম, নানারূপ ছদ্মবেশ ধরিয়া তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে রহিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে হাতে পাইলাম না।
তাহারা কলিকাতা হইতে কাশী, কাশী হইতে এলাহাবাদ, আগ্রা, দিল্লী হইয়া লাহোরে আসিল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে আসিলাম। এক দিনের জন্য ও তাহাদের চক্ষের অন্তরাল হইতে দিলাম না।
লাহোরে আসিয়া তাহারা বাসা হইল । আমিও সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া তাহাদের বাসা দেখিলাম; কিন্তু লাহোরেও এই দুরাত্মার দণ্ড দিবার সুবিধা কিছুতেই পাইলাম না। এখানে আসিয়া তাহারা নিশ্চয় মনে করিয়াছিল যে,এ পর্যন্ত আর আমি তাহাদের সঙ্গ লই নাই। তাহারা আমার হাত এড়াইয়াছে। তাহারা এখানে আসিয়া ভারি সুখী হইল। বালকিষণ দিন রাত্রি প্রায় মাতাল হইয়া থাকিত।
তাহার যখনই বাহির হইত, তখনই গাড়ী করিয়া বাহির হইত, সুতরাং তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড়ই ক্লেশকর হইয়া উঠিল। গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়, পাছে তাহারা আমার চোখের আড়াল হয়, এই ভাবিয়া আমি বড়ই চিন্তিত হইলাম। ভাবিয়া ভাবিয়া শেষে আমি একটা উপায় স্থির করিলাম।
একজন বড় এক্কাওয়ালার সঙ্গে দেখা করিলাম। তাহার অনেক একা ছিল। বন্দোবস্ত হইল, দিন হিসাবে এক টাকা লইয়া সে তাহার একা ও ঘোড় আমাকে ভাড়া দিবে। লোকে এক্কা লইয়া সমস্ত দিন ভাড়া খাটিয়া এক টাকার উপর যাহা পাইত লইত, এক টাকা তাহাকে দিত। আমিও এই বন্দোবস্তে তাহার নিকট হইতে একখানি একা লইলাম। তথন বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড় সুবিধাজনক হইল।
আমি প্রায় এক্কা লইয়া তাহাদের বাসার নিকট ঘুরিতাম। এক দিন সন্ধ্যার সময় দেখি একখানা গাড়ী তাহাদের বাসার সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহাদের জিনিষ-পত্র গাড়ীর ছাদে উঠিল। পরে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং গাড়ীতে আসিয়া বসিল। গাড়ী ষ্টেশনের দিকে চলিল, আমিও আমার একা ঐ গাড়ীর পিছনে পিছনে চালাইলাম।
তাহারা ষ্টেশনে আসিল, মুটেরা তাহাদের জিনিষ-পত্র নামাইয়া, কল। সামি মন একন এওয়ালাকে আমার এক্কা দেখিতে বলিয়া সত্বর তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেশনের ভিতর চলিলাম। পাণ্ডুরাং খবর লইয়া জানিল যে, তখনও গাড়ীর অনেক বিলম্ব আছে।
এই কথা শুনিয়া বালকিষণ তাহাকে বলিল, তবে তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমার একটা বিশেষ কাজ আছে, সেরে আসছি।
পাণ্ডুরাং ইহাতে আপত্তি করিল, কিন্তু বালকিষণ তখন বেশ মাতাল,-তাহাকে কুৎসিত গালি দিয়া উঠিল। পাণ্ডুরাং তাহার হাত ধরিতে গেলে সে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিল। আমি আমার এক্কায় উঠিবার আগেই সে সত্বর একখানা এক্কায় উঠিয়া হাঁকাইতে আজ্ঞা করিল। যো হুকুম বলিয়া এক্কাওয়ালা তাহার ঘোড়াকে সবলে চাবুক মারিল; ঘোড়া তীর বেগে ছুটিল। আমিও আমার এক্কা তাহার পশ্চাতে ছুটাইলাম।
বালকিষণের এক্কা পথে একটা মদের দোকানে থামিল। বালকিষণ নামিয়া গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে সে টলিতে টলিতে আবার আসিয়া এক্কায় উঠিল—এক্কা চলিল। আমি দেখিলাম, এক্কা তাহাদের বাসার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভাড়া লইয়া এক্কাওয়ালা চলিয়া গেল। বালকিষণ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমি আমার একা লইয়া সেইখানে ঘুরিতে লাগিলাম।