আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিলাম। তিনি আমাকে একটা দোকানে লইয়া গিয়া আহার করাইলেন। আহার করিয়া আমি শরীরে বল পাইলাম, মনেও পূৰ্ব্ব-তেজ দেখা দিল। বলিলাম, আপনি সর্দার বালকিষণের কোন সংবাদ রাখেন?
তিনি বলিলেন, সব বলিতেছি,—সঙ্গে এস।
আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। আমরা উভয়ে সহরের বাহিরে একটা নির্জন ভাঙ্গা মন্দিরের নিকট আসিলাম। তিনি বলিলেন, এখানে কেহ নাই,-বস। সব বলিতেছি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
গঙ্গাধর রাও কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, চন্দন আর নাই।
তিনি ভাবিয়াছিলেন, এ সংবাদে আমি নিতান্তই বিচলিত হইব, কিন্তু আমি তাহা না হওয়ায় তিনি বরং একটু বিচলিত হইলেন। আমি বলিলাম, আমি তা জানি।
তিনি বলিলেন, কেমন করিয়া জানিলে?
আমি। চলন আমাকে বলে গিয়েছিল।
গঙ্গা। বলে গিয়েছিল?
আমি। হাঁ,—সে আত্মহত্যা কবে বলে গিয়েছিল।
গঙ্গা। হাঁ, সত্য-সত্যই সে আত্মহত্যা করেছে।
আমি। আপনি যা কিছু জানেন, সব বলুন। আমি কিছুমাত্র কাতর হব না।
গঙ্গা। চন্দন বাঈকে নিয়ে তারা সেইদিন সর্দারের বাড়ী চলে যায়, কিন্তু সর্দার বা পাণ্ডুরাং যায় না। পাছে হঠাৎ চলে গেলে, লোকে সন্দেহ করে, সেজন্য দুজনে আরও তিন চারি দিন গ্রামে ছিল।
আমি। লোকে বা তারা এ বিষয়ে কি বলেছিল, বলতে পারেন?
গঙ্গা। হাঁ, ডাকাতে যে তোমাদের মেরে চন্দনকে কেড়ে নিয়ে গেছে, এই সকলের বিশ্বাস। পুলিশও তদন্ত করে তাই রিপোর্ট করেছে। এখনও তারা ডাকাত খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমি। আমি তাদের বলে দেব, এ ডাকাত কে।
গঙ্গা। কিছুই হবে না, বাপু। কে করেছে তা তারা বেশ জানে। সর্দার তাদের বেশ খাইয়েছে।
আমি। আচ্ছা, এর সাজা আর কেউ না দেয়, আমি নিজের হাতেই দেব।
গঙ্গা। গ্রামের লোকে আমাকে ভক্তি-সম্মান করে, বলে আমাকে হাত করবার জন্য তার পর দিন সর্দার আমাকে ডেকে পাঠিয়ে চারী দিতে চায়। চারী নিলে কোন-না-কোন সুযোগে আমি চন্দনকে উদ্ধার করতে পারব বলে আমি তার চারী নিতে স্বীকার করলেম।
আমি। ভালই করেছিলেন।
গঙ্গা। আমি সর্দারের সঙ্গে তার বাড়ী এলেম। পরদিন সর্দা রের রাগ রাগ ভাব দেখে ভাবলেম যে, একটা কিছু কাণ্ড হয়েছে। আমি গোপনে গোপনে সন্ধান করতে লাগলেম।
আমি। কি জানতে পারলেন?
গঙ্গা। জালেম—অনেক কষ্টে যদিও জানতে পেরেছিলাম, জালেম, যে সর্দার সেই রাত্রেই চন্দনের সঙ্গে দেখা করে, কিন্তু শীঘ্রই তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চন্দন তার সম্মুখেই নিজের বুকে নিজে চুরি বসিয়েছিল।
আমি। তা আমি জানি।
গঙ্গা। তার পর সেই রাত্রেই বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ধরাধরি করে চন্দনের মৃতদেহ বাড়ীর কাছে একটা জঙ্গলের মধ্যে কোথায় পুতে রেখে চলে আসে। বাড়ীর দুই-চারিজন দাস-দাসী ভিন্ন আর কেউ এ কথা জানে না।
আমি। ইয়ারিং।
গঙ্গা। ইয়ারিং কি?
আমি। ওঃ! আপনি তা জানেন না, আর শুনে কাজ নাই।
গঙ্গা। এখন কি করবে?
আমি। কৰ্তব্য—পাপীর দণ্ড।
গঙ্গা। পাপীর দণ্ড ভগবান দেবেন। এখন দেশে ফিরে যাও, ঘর-দরজা বিষয়-সম্পত্তি দেখবার কেউ নাই।
আমি। কার জন্য দেশে যাব? দেশে যাব না। পাপীর দণ্ড দিব। আপনি আমার একটা কাজ করবেন। আপনি আমাকে ছেলের মত ভালবাসেন, তাই বলি।
গঙ্গা। বল।
আমি। আমি ত্ৰিশখানা কাগজ আপনাকে দিব, আপনি কোন গতিকে এক-একখানা কাগজ এই পাপাত্মা সর্দারের বিছানায় রাত্রে রেখে দিতে পাবেন?
গঙ্গা। বোধ হয় পাব—চেষ্টা কব-কাগজ দেবার অর্থ কি?
আমি। কাগজে কিছু লিখে দিব। আমি এই পাপিষ্ঠকে কাপুরুষের মত সহসা খুন করে আমার হাত কলঙ্কিত করব না, সে ইচ্ছা আমার নাই। একমাস ওকে সময় দেব; দুজনে লড়ব, যে হয় একজন মরবে।
গঙ্গা। যদি না লড়তে চায়?
আমি। আমি বিষের বড়ী তয়েরী করতে জানি। একটা বিষ বড়ী আর একটা ঠিক সেই রকম দেখতে অবিষাক্ত বড় একটা কৌটায় রেখে তাকে যেটা ইচ্ছে বেছে নিয়ে খেতে বলব। অন্যটা আমিও খাব। হয় সে মরবে—না হয় আমি মরব।
গঙ্গা। যদি না খায়।
আমি। খাবে না! জোর করে খাওয়াব।
এই বলিয়া আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। অমনি ঝর ঝর করিয়া আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল; দেখিয়া গঙ্গাধর রাও ভীত ও স্তম্ভিত হইলেন। ছুটিয়া গিয়া নদী হইতে কাপড় ভিজাইয়া জল আনিয়া আমার নাকে মুখে মাথায় দিতে লাগিলেন। রক্ত বন্ধ হইল, আমিও প্রকৃতিস্থ হইয়া বসিলাম।
গঙ্গাধর রাও বলিলেন, তোমার শরীর এখনও ভাল হয় নাই। আমার কথা শোেন, দিন কত দেশে গিয়ে শরীর সুস্থ কর, তার পর যা হয় কয়রা।
আপনার সব কথা শুনব, কেবল ঐটা নয়।
তবে কি কবে?
সর্দার আর পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে যাব।
তারা সব নাসিকে রয়েছে।
তা হলে ভালই হয়েছে, আর খুঁজতে যেতে হবে না।
কোথায় থাকবে মনে করেছ। আমার কাছে থাকলে ওরা আমাকে সন্দেহ করবে।
আমি একটা বাসা খুঁজে নেব।
টাকা কড়ি-কিছু সঙ্গে আছে?
কিছু না।
গঙ্গাধর রাও নিজ বন্ত্রের ভিতর হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। বলিলেন, লও, এখন খরচ চালাও, পরে শোধ দিলেই চলবে।
আমার কাছে একটি পয়সাও ছিল না, সুতরাং আমি লইলাম। বলিলাম, আপনি দেশে চিঠী লিখে দিন, যেন তারাই আমার বিষয়-সম্পত্তি দেখ।
আচ্ছা তাই হবে। বোজ রাত্রি নটার সময় এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা হবে। যা হয় তা খবর দিব।