আমি কি বলিব, কিরূপে তাহাকে প্রবুদ্ধ করিব? আমি কোন কথায়ই কহিতে পারিলাম না। সকলে নীরবে পথতিবাহিত করিতে লাগিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
আমরা আরও প্রায় এক ক্রোশ পথ চলিলাম, তখন প্রায় একটা বাজিল। এই সময়ে সহসা পথিপাশ্বত একটা ঝােপের মধ্যে একটা বিকট শব্দ হইল। আমরা চারিজনই স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। অমনই প্রায় বিশ-পঁচিশজন লোক আসিয়া আমাদের ঘেরিয়া ফেলিল। আমি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে তরবারি খুলিলাম; কিন্তু গুণবস্তু ও তরোয়াল খুলিবার সময়ই পাইলেন না; এক দুরাত্মা তাহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি তুলিল। আমি লম্ফ দিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে অগ্রসর হইলাম, কিন্তু তাহার নিকট পৌছিবার পূর্বেই তাঁহার মস্তকে তরবারি পড়িল। আমি দেখিলাম যে আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী আসিয়া স্বামীর উপর পড়িলেন, তৎপরে উভয়েই ভূমিশায়ী হইলেন।
আমি আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। অমনই দশ-বারজনে আমাকে ঘেরিল। আমি তাহাদিগের পাঁচ-ছয়জনকে আহত করিলাম। তখন একবার দেখিলাম, পাষণ্ড পাণ্ডুরাং চন্দনের হাতমুখ বাঁধিয়া তাহাকে একটা ঘোড়ার উপর তুলিতেছে। আমি উন্মত্তের ন্যায় সেই দিকে ছুটিলাম। আমি এইরূপে একটু অসাবধান হইবামাত্র দুই তিন জনে আমাকে আঘাত করিল; আমি চারিদিকে যেন হাজার হাজার সূর্যের আলো দেখিলাম; তৎপরে বোধ হইল, যেন কে আমাকে ঘোর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করিল। তাহার পর আমি—তাহার পর কি হইল আর জানি না।
যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি দেখিলাম, আমি রাস্তার পাশে একটা নর্দমায় পড়িয়া আছি। উঠিতে চেষ্টা করিলাম, পারিলাম না। তখন দেখিলাম, আমি গুরুতররূপে আহত হইয়াছি, অনেক রক্ত পড়ায় নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। দেখিলাম, তখন বেশ বেলা। হইয়াছে, চারিদিকে খুব রৌদ্র।
এখানে থাকিলে বাঁচিব না, ভাবিয়া আমি কষ্টে রাস্তায় উঠিবার চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু পারিলাম না, চীৎকার করিয়া আবার পড়িয়া গেলাম। এই সময়ে সেই রাস্তা দিয়া কতকগুলি চাষা যাইতেছিল, তাহারা আমার চীৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি নর্দামার নিকট আসিল। আমি বাঁচিয়া আছি দেখিয়া তাহারা তিনচার জন নর্দামার মধ্যে। নামিল, এবং অনেক কষ্টে ধরাধরি করিয়া আমাকে উপরে তুলিল।
আমি দেখিলাম, গুণবন্ত রাও রক্তাক্ত কলেবরে রাস্তার উপর পড়িয়া আছেন। আরও দেখিলাম, আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী স্বামীকে রক্ষা করিতে গিয়া নিজেই হত হইয়াছেন। চন্দনের কোন চিহ্ন নাই। এই লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, দারুণ মানসিক উত্তেজনায় আমার ক্ষতবিক্ষত দেহে আবার রক্ত ছুটিল, আবার আমি অবসন্ন হইয়া পড়িলাম, আবার আমার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল। তাহার পর কি হইল, আমার স্মরণ নাই।
যখন আমার সংজ্ঞা হইল, তখন আমি যে কোথায় আছি, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ক্রমে বুঝিলাম, আমি হাসপাতালে। পরে জানিলাম, আমি নাসিকের হাসপাতালে আসিয়াছি,। কৃষকেরা পুলিশে সংবাদ দেওয়ায় তাহারা আমাকে জীবিত দেখিয়া হাসপাতালে পাঠাইয়াছিল।
আমি দিন-দিন আরােগ্য লাভ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম। আমাদিগকে ডাকাতে আক্রমণ করিয়াছিল, ডাকাতগণ গুণবন্ত রাও ও তাহার স্ত্রীকে খুন করিয়া আমাকে অর্ধমৃত অবস্থায় রাখিয়া সমস্ত কাড়িয়া লইয়া পলাইয়াছে,এই বলিয়া পুলিশ রিপোর্ট করিয়াছে। চন্দন বাঈকে ডাকাতের লইয়া গিয়াছে,পুলিশ অনেক চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু এখনও ডাকাতদের কোন সন্ধানই করিতে পারে নাই।
কেবল আমিই জানিতাম যে, আমরা ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হই নাই। সর্দার বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংই চন্দন বাঈকে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু এ কথা হাসপাতালের কাহাকেও বলা আমি যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিলাম না।
প্রায় এক মাস হাসপাতালে পড়িয়া থাকিয়া আমি আরোগ্য লাভ করিলাম। পরে শরীরে বল পাইলে একদিন হাসপাতাল হইতে বাহির হইলাম। সর্দার ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধান করা এবং তাহাদের সমুচিত দণ্ড দেওয়াই আমার তখন জীবনে একমাত্র কর্তব্য। চন্দন বাঙ্গ কি এখনও বাঁচিয়া আছে? শেষ দিন সে আমাকে যাহা যাহা বলিয়া গিয়াছিল,তাহা আমার হৃদয়-কন্দরে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখিত ছিল। আমি বস্ত্রাভ্যন্তরে হাত দিয়া দেখিলাম তাহার সেই ইয়ারিং তখনও তথায় আছে। সেই ইয়ারিং স্পর্শ করায় আমার শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল, আমি উন্মত্তের প্রায় হইলাম। আমি উন্মাদের ন্যায় সমস্ত দিন নাসিক সহরের রাজপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলাম।
এইরূপে দুইদিন কাটিয়া গেল। এই দুইদিন আহার নিদ্রা আমার কিছুই ছিল না। তিন দিনের দিন শরীর একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িল; আমি গোদাবরীর তীরে একটা বাঁধা-ঘাটে ইয়া পড়িলাম। দেখিতে দেখিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম। কতক্ষণ যে আমি নিদ্রিত ছিলাম—তাহা জানি না।
কে আমার মাথা ধরিয়া নাড়া দেওয়ায় আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলাম। দেখিলাম, আমাদের গ্রামের বৃদ্ধ গঙ্গাধর রাও,-গুণবন্ত রাওয়ের সঙ্গে ইহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ইনি আমাকে পুত্র নির্বিশেষে ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, এখানে কেন, কবে হাসপাতাল থেকে বেরুলে?
আমি। এই তিন দিন হল?
গঙ্গা। কোথায় আছ?
আমি। কোথাও নয়। যাবার স্থান কোথায়?
গঙ্গা। এস, আগে তোমার কিছু খাওয়া আবশ্যক।