আমি। আপনি কি করতে চান?
গুণবন্ত। এখনই পালিয়ে ইংরেজ রাজের নাসিক সহরে যাওয়া। এখন থেকে রেল ষ্টেশন দশ ক্রোশ, কোন রকমে ষ্টেশনে পৌঁছিতে পারলে আর কোন ভয় নাই।
আমার শাশুড়ী বলিলেন, তবে আর দেরী কর না।
কি করি, অগত্যা আমি ও পলাইতে স্বীকার করিলাম। তখনই আমরা সকলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। গুণবন্ত রাও তাহার মূল্যবান্ দ্রব্যাদি বাধিয়া একটা পোটলা করিলেন। টাকা কড়ি আমরা সব কোমরে বাঁধিলাম, কিছু বিছানা-পত্রও সঙ্গে লইলাম।
পাছে কেহ জানিতে পারে বলিয়া আমরা গাড়ী বা মুটে কিছুই সংগ্রহ করিলাম না। চারিজনে আমরা নিজেদের দ্রব্যাদি কাধে করিয়া লইয়া যাওয়া স্থির করিলাম।
রওনা হইবার সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির হইলে আমার স্ত্রী আমাকে এক পাশে ডাকিয়া লইয়া বলিল, বোধ হয়, আমাদের এই শেষ দেখা। আমার মনে নিচ্ছে যে, তোমায় আমায় স্বর্গে না গেলে আর দেখা হবে না।
আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় করছ। সদ্দার আমাদের কিছুই করতে পারবে না। নিশ্চয় জেন, আমার প্রাণ থাকতে তোমার গায়ে কেহ হাত দিতে পাবে না।
চলন। আমাদের সহায় ভগবান্।
আমি। একবার ষ্টেশনে পৌছিতে পারলে আমাদের কে কি করে?
চন্দন । যাই হউক, ভগবান্ করুন আমাদের আর কোন বিপদ আপদ না হয়; কিন্তু যদি কিছু ঘটে, তবে আমার একটা কথা তোমায় বল্বার আছে।
আমি। বল।
চন্দন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বল যে, তার কথা রাখবে।
আমি। নিশ্চয় রাখব। কবে না তোমার কথা রেখেছি?
চন্দন নিজ বাম কর্ণ হইতে তাহার সোণার সুন্দর ইয়ারিং আনার হাতে দিয়া বলিল, এই ইয়ারিংটা যত্নে রেখ। আমার কথা পাছে তুমি ভুলে–
আমি বাধা দিয়া বলিলাম, এ কথা কখনও মুখে এনো না।
চন্দন। তা নয়, তবে এটা তোমার কাছে থাকলে আমার কথা তোমার মনে থাকবে।
আমি। আমি দিনরাত এই ইয়ারিং বুকে বুকে রাখব। চন্দন। আমাকে যদি এরা কোন গতিকে জোর করে তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায়, তা হলে আমি আর বাঁচব না। আত্ম হত্যা কব। এই দেখ।
এই বলিয়া চন্দন নিজ বস্ত্র মধ্য হইতে একখানি শাণিত ছুরিক বাহির করিল। আমি কোন কথা কহিলাম না। চন্দন বলিল,প্রথমে পাপাত্মা দের উচিত দণ্ড দেবার চেষ্টা করব। তা যদি না পারি, নিজে মরব।
আমি বলিলাম, তুমি মারাঠী রমণী, তোমার যা করা কর্তব্য তাই করো।
চন্দন। হাঁ, করব। আমি তোমার অনুপযুক্ত নই। তাই বলছি এই একটা ইয়ারিং আমার কাণে থাল। যদি আমি ফিরে আসি ভালই; না হলে জাবে আমি আর এ জগতে নাই। যদি এই ইয়ারিং তোমার হাতে আসে, তবে বুঝবে আমি পাপীর উপযুক্ত দণ্ড দিয়ে মরেছি। আর যদি এ ইয়ারিং ফিরে না আসে, তবে বুঝবে পাপীর দণ্ড হয় নাই। প্রতিজ্ঞা কর—
আমি। কি প্রতিজ্ঞা, বল। চন্দন। ভগবানের নামে প্রতিজ্ঞা কর—
আমি। বল।
চন্দন। যেমন করে হয়,এই পাপাত্মাদের দণ্ড দেবে,—কেবল দণ্ড নয়—প্রাণদণ্ড।
আর চন্দন কথা কহিতে পারিল না। সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। আমার সর্ব শরীরে শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল। আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় পাচ্ছ। যদি যথার্থই কেহ তোমার উপর অত্যাচার করে, তবে জেন, এই তোমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ করে বছি, তার রক্ত না দেখে—তার মৃতদেহ না দেখে আমি নিশ্চিন্ত হব না।
চন্দন। তা হলে চল, আর দেরী করে কাজ নাই। বাবা মা ব্যস্ত হয়েছেন।
আমরা বাহিরে আসিলাম। তখন রাত্রি প্রায় নয়টা। গ্রাম অতি নিস্তব্ধ, রাস্তায় লোকের চলা-ফেরা প্রায় বন্ধ হইয়াছে, কোনদিকে কোন শব্দ নাই, আমরা সুযোগ বুঝিয়া ধীরে ধীরে চারি জনে বাহির হইলাম। আমাদের তীক্ষ্ণধার দুইখানি তরবারি সুদৃঢ়ভাবে কোমরে বাঁধিয়া লইলাম।
কোনদিকে কেহ নাই দেখিয়া আমরা নিঃশব্দে আমাদের দ্রব্যাদি লইয়া অন্ধকারে বাহির হইয়া পড়িলাম। দ্রুতপদে ষ্টেশনের পথে রওনা হইলাম। আমার বোধ হইল, যেন কে একজন আমাদের বাড়ীর সম্মুখস্থ গাছের পাশে লুকাইয়া ছিল; আমাদিগকে দেখিয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। আমি এ কথা গুণবন্ত রাওকে তখনই বলিলাম।
তিনি বলিলেন,পাণ্ডুরাং যে রকম লোক তাতে সে অপমান জীবনে ভুল বার লোক নয়। বোধ হয়, আমরা কি করি না করি, দেখবার জন্য পাহারায় লোক রেখেছিল?
গুণবন্ত। বলতে পারি না, চল শীঘ্র যাওয়া যাক।
আমি। যদি আমাদের উপর অত্যাচার করতে আসে, তা হলে দু-দশটাকে আর ঘরে ফিরে যেতে হবে না।
গুণবন্ত রাও কোন কথা কহিলেন না। আমিও আর কোন কথা না কহিয়া সত্বরপদে চলিলাম। দুইটী স্ত্রীলোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটিল।
এইরূপে রাত্রি প্রায় বারটা পর্যন্ত আমরা চলিলাম। পথে কোনই বিপদ-আপদ ঘটিল না। তখন আমরা সকলে মনে ভাবিলাম যে, এখন আমরা সর্দারের হাত হইতে উদ্ধার হইয়াছি, আর কোন ভয় নাই। এতক্ষণ আমরা একরপ ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছিলাম, এখন একটু ধীরে ধীরে চলিলাম। এতক্ষণ অন্ধকার ছিল, এখন জ্যোৎস্নায় চারিদিক বেশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।
গুণবন্ত রাও বলিলেন, বোধ হয় আর ভয় নাই?
আমি বলিলাম, বেটারা কি এতদূর এসেও ধরবে?
আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী বলিলেন, আমাদের সহায় ভগবান আছেন।
আমি আমার স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিলাম। সে ঘাড় নাড়িল। আমি তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, সে বলিতেছে, ভয় যায় নাই। বিপদ এখনও আছে।