কিন্তু এ পর্যন্ত সে আমাদিগের উপর কোন অত্যাচার করে নাই; আমাদের গ্রামবাসীর উপরও কোন অত্যাচার হয় নাই, কিন্তু আমাদের সুখের দিন শীঘ্রই শেষ হইয়া আসিল। আমরা দেখিলাম, অসংখ্য লোক জন আসিয়া আমাদের গ্রামের প্রান্তভাগে অনেক তাম্বু ফলিল। শুনিলাম, সদ্দার বালকিষণ রাও কাল আমাদের গ্রামে আসিবেন। তিনি নিকটস্থ বনে শিকার করিতে আসিতেছেন।
পর দিবস বালকিষণ বহু লোকজন সমভিব্যাহারে আসিল। দুই তিন দিন শিকার করিল, তাহার লোকজন গ্রামের লোকের উপর নানা রকমে অত্যাচার করিতে লাগিল। খাদ্যদ্রব্যাদি কাড়িয়া লইতে লাগিল, এমন কি ভদ্রলোককে ধরিয়া কুলীর কাজও করাইতে লাগিল। শুনিলাম, স্ত্রীলোকদিগের উপর অত্যাচার করিতে ত্রুটি করিল না। গ্রামবাসিগণ স্থানে স্থানে গোপনে সমবেত হইয়া নানা কথা কহিতে লাগিল, কিন্তু দুর্দান্ত সর্দারের বিরুদ্ধে কোন কথা কহিতে বা সরকার বাহাদুরের নিকট নালিশ করিতে কাহারও সাহস হইল না।
একদিন সর্দারের একজন লোক আসিয়া গুণবন্ত রাওকে সর্দারের নিকট ডাকিয়া লইয়া গেল। গুণবন্ত রাও অতি বিষঃচিত্তে ফিরিয়া আসিলেন। আমি তাহার বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কেবলমাত্র বলিলেন, না, কিছু নয়।
পরদিন সর্দারের নিকট হইতে তাহাকে ডাকিতে পুনঃ পুনঃ লোক আসিলে ও তিনি গেলেন না নানা অজুহত দেখাইয়া তাহাদিগকে বিদায় করিলেন। আমি তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, আপ নাকে সর্দার এমন করিয়া ডাকিয়া পাঠাইতেছেন কেন?
তিনি প্রথমে নানা কথা বলিয়া আমার কথা উড়াইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু শেষে আমি নিতান্ত পীড়াপীড়ি করায় তিনি বলিলেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না।
আমি প্রাণে বড় কষ্ট পাইলাম। গুণবন্ত রাও আমাকে পুত্র। নিৰ্বিশেষ ভালবাসিতেন, আমাকে কোন কথা কখনও গোপন করি তেন না,কিন্তু আজ অতি বিষণ্ণভাবে বলিলেন, তোমার সে কথা শুনিবার আবশ্যক নাই। আমি তাহার ভাব দেখিয়া আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলাম না।
এদিকে গুণবন্ত রাও নানা ওজরে সর্দারের সহিত সাক্ষাৎ না করিলেও সর্দার তাহাকে ছাড়িল না। বৈকালে তাহার প্রধান অনুচর পাণ্ডুরাং আমাদের বাড়ী আসিল; গোপনে কথাবার্তার জন্য ও বন্ত রাওকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গেল। আমি আর কৌতূহলবৃত্তি দমন করিতে পারিলাম না, সেই গৃহের দরজার পাশ্বে লুকাইত থাকিয়া তাহাদের কথা শুনিতে লাগিলাম।
পাণ্ডুরাং বলিতেছেন, সর্দারকে তুমি এখনও চিনিতে পার নাই। তিনি রাগ করিলে তোমার সর্বনাশ হবে। তার যা সখ হয়, তা কে খাতে পারে।
গুণবন্ত রাও কাতরভাবে বলিলেন, তিনি আমাদের জমীদার, তিনি আমাদের মা বাপ। তিনি অত্যাচার করিলে কার কাছে আমরা দাঁড়াব।
পাণ্ড রাং। ও সব বাজে কথা এখন ছেড়ে দাও। যত টাকা চাও দিতেছি। তোমার মেয়ে রাজ-রাণী হয়ে থাকবে।
গুণবন্ত। ও কথা মুখে আবেন না। মনে করুন দেখি, যদি আপনার মেয়ে হত ত কি করতেন? সে বিবাহিত, তার স্বামী আছে।
পাণ্ডরাং। ভাল কথায় না শোন, তোমারই সর্বনাশ। সহজে সম্মত হওমেয়ে রাজরাণী হবে—নতুবা তোমার মেয়েকে চাকরাণীর অধম হয়ে থাকতে হবে।
গুণবন্ত। সংসারে কি ভগবান নাই। গরিবের বন্ধু ভগবান। ইংরেজ রাজও আছে।
পাওরাং হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, ভাল কথা শুলে না, আজ রাত্রেই তোমার মেয়েকে জোর করে নিয়ে যাব, কোন্ বাবা রাখে দেখা যাবে?
আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না। একেবারে সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া সিংহ-বলে মহাপাপীকে আক্রমণ করিলাম। সে আশ্চর্যান্বিত ও স্তম্ভিত হইয়া গেল। আমি তাহাকে বারংবার পদাঘাতে একেবারে বাড়ীর বাহিরে আনিয়া ফেলিলাম। সে দুই একেবার বল প্রকাশের চেষ্টা করিল, কিন্তু আমি তখন একেবারে মরিয়া। আমি তাহাকে পদাঘাতের উপর পদাঘাতে আমাদের বাটির সম্মুখস্থ নর্দমায় ফেলিলাম। কতক্ষণ পরে সে একটু প্রকৃতস্থ হইয়া নর্দমা হইতে উঠিল। ধূলা ও কদ্দমে আপ্লুত হইয়া অতি কষ্টে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে সর্দারের তাম্বুর দিকে চলিল; একবার আমার দিকে বিকটভাবে চাহিল, আমি তাহা গ্রাহ্য করিলাম না।
সে দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলাম। দেখিলাম, গুণবন্ত রাও, তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া ম্লানমুখে বসিয়া আছেন। সকলেই ব্যাকুল ও বিষ। আমাকে দেখিয়া কাতর ভাবে বলিলেন, ত্ৰিষক, ভাল কাজ করিলে না?
আমি বলিলাম, হাঁ, ব্যাটাকে একবারে প্রাণে না মানায় কাজটা ভালই হয় নাই বটে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
বহুক্ষণ আমরা কেহ কোন কথা কহিলাম না। শেষে আমার শঠাকুরাণী বলিলেন,এখন চুপ করে বসে থাকলে আমাদের চন্দনকে আমরা কেমন করে রক্ষা করব?
আমি বলিলাম, আমি কি মরিছি? আমার শরীরে কি এক বিন্দুও মারাঠী রক্ত নাই। প্রাণ থাকিতে আমার স্ত্রীর গায় হাত দেয় এমন সাহস কার?
গুণবন্ত রাও বলিলেন, বাবা, তুমি যে পরম সাহসী তা কে না স্বীকার করে? কিন্তু আমরা দুজন, দুজনে সর্দারের লোকের সঙ্গে কত ক্ষণ লড়তে পারি?
আমি। যতক্ষণ প্রাণ থাবে লড় ব।
গুণবন্ত। ও সব পাগলের কথা। আর আমাদের এ গ্রামে তিলাৰ্ক থাকা উচিত নয়। তারা এখনও যে কিছু করে নাই, সে কেবল ইংরেজ রাজের ভয়ে। অনেক রাত্রে যখন গ্রামের সকলে ঘুমাবে, তখনই আসবে।