আমি। তা নিশ্চয়ই।
গোবিন্দ। আর এক্কাওয়ালা হলে সহজে কেউ চিতেও পাবে। এইজন্যই আমি ছোঁড়াদের এক্কাওয়ালা খুঁজতে লাগিয়া দিয়েছিলেন।
আমি। আপনার কথায় আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, একটু বুঝে দেখলে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছুই নাই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এ নাম বদলেছে; বদলে থাকলেও আমি এর চেহারা যেরূপ অনুমান করেছিলাম,তাতে সহজেই ধরা পড়ত। দ্বিতীয়তঃ আমি ভেবেছিলাম, এ নাম বলায় নাই। কেন বদলাবে? এত দূরে এক্কাওয়ালার মধ্যে নিজের নাম রাখলে ক্ষতি কি? আমার অনুমানই ঠিক, এ নিজের নামেই ছিল। আমার ননীয়া একে সহজেই ভাড়ার নাম করে ডেকে আনতে পেরেছিল।
আমি। কিন্তু এ ভাড়ায় এল কেন?
গোবিন্দ। না এলে পাছে কেউ সন্দেহ করে।
আমি। এত অনায়াসে খুন করে লাহোর থেকে চলে যেতে পাত।
গোবিন্দ। ত্রিম্বক গাধা নয়। সে স্পষ্টই জান্ত, পুলিশ এখন ষ্টেশনে বিশেষ দৃষ্টি রেখেছে। হঠাৎ একজন এক্কাওয়ালা অন্তর্ধান হলে পুলিশের তার উপর সন্দেহ হবে। তখন পুলিশের হাত এড়িয়ে পালান বড় শক্ত। একটু গোল চুকলেই সরে পড়বার ইচ্ছা ছিল।
আমি। আপনার ক্ষমতা অদ্ভুত। আপনি অদ্বিতীয় লোক।
গোবিন্দ। তা ঠিক নয়, তবে আমার গোয়েন্দাগিরি সম্পূর্ণ নুতন, পুরাণ ধাঁজায় নয়।
আমি। তা ত চোখের উপর দেখলেম। আপনি যা বলেছিলেন, তাই করলেন। ঘরে বসে দু-দুটো এমন জটিল খুনের আসামী গ্রেপ্তার করলেন।
গোবিন্দ। আমার রীতি অবলম্বন করলে সকলেই তা পারবে।
আমি। একটা কথা জান্বার আছে।
গোবিন্দ। বলুন।
আমি। ইংয়ারিংএর বিষয়টা কি?
গোবিন্দ। ত্রিম্বকের ইতিহাসেই সব জানা যাবে। কালই সব জানতে পারবেন।
অনেক রাত্রি পর্যন্ত এইরূপ কথোপকথনে কাটিল। প্রাতেই রাম সিংএর একখানা পত্ৰ আসিল। তিনি আমাদিগকে তথনই থানায় যাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। আমরা আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিলাম না, একখানা গাড়ী করিয়া থানায় উপস্থিত হইলাম। রাম সিং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখনই আমাদিগকে হাজতে লইয়া গেলেন।
******
আমরা দেখিলাম, ত্রিম্বক রাও শয়ন করিয়া আছে। তাহার চতুষ্পর্শে কালি কলম কাগজ বিক্ষিপ্ত; অনেকগুলি কাগজ লেখা কিন্তু ত্রিম্বক রাও আর নাই; নিম্নের বিচারকের হাত এড়াইয়া এখন সে সেই সর্বজ্ঞ সৰ্বশক্তিমান্ বিচারপতির আসন সম্মুখে নীত হইয়াছে। তাহার মুখ দিয়া যথেষ্ট রক্ত নির্গত হইয়াছে। রক্তপিত্ত রোগেই ত্রিম্বক রাওয়ের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার মৃত্যুতে রাম সিং মহাশয়কে বিশেষ দুঃখিত দেখিলাম, কারণ আসামীর ফাঁসী হইলে তাহার প্রমোসনের একটা আশা ছিল। আমি কিন্তু ত্রিম্বকের মৃত্যুতে হৃদয়ে বড়ই ব্যথা পাইলাম।
গোবিন্দ বাবু ত্রিম্বকের লেখা কাগজ গুলি গুছাইয়া লইয়া পড়িতে লাগিলেন। আমিও কতকটা পড়িলাম। দ্বিতীয়াংশে ত্রিম্বকের আত্ম কাহিনী লিপিবদ্ধ হইল।
২য় খণ্ড – আসামীর লিখিত
দ্বিতীয় খণ্ড।
(আসামীর লিখিত।)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
কেন খুন করিলাম? লোকে আমাকে খুনী মনে করে, এ আমি ইচ্ছা করি না। তাই এ হাজতে আমার জীবনের কয়েকটি কথা লিখিয়া রাখিয়া যাওয়া নিতান্ত আবশ্যক মনে করিয়াছি, এবং সেই জন্য লিখিতেছি।
ছেলেবেলা হইতেই আমার মা বাপ নাই। তাহাদের কথা এখন একেবারেই আমার মনে পড়ে না। শুনিয়াছি, আমি যখন মাতৃগর্ভে তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। সেই শশাকে আমার মা পীড়িত হন। আমার বয়স এক বৎসর হইতে না হইতে তিনিও আমাকে ছাড়িয়া পিতার সহিত মিলিতে স্বর্গে যান।
গুণবন্ত রাও নামে পিতার একজন বন্ধু ছিলেন। তিনিই অনুগ্রহ করিয়া আমায় লালন-পালন করিতে থাকেন। আমার মৃত্যু হইল, তাঁহার ও তাহার গুণবতী জননীর যত্নে আমি দিন-দিন বড় হইতে লাগিলাম।
নাসিকের নিকট সাতগাঁও নামে গ্রামে গুণবন্ত রাও বাস করি তেন। তিনি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন, কিছু জমীজারাত ছিল, তাহাই চাষবাস করিয়া তাহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলিত। তিনি দুরাত্মা সর্দার বালকিষণ রাওএর প্রজা ছিলেন। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন বালকিষণ জমীদার হয় নাই, তাহার পিতা জমীদার ছিলেন।
যখন আমার বয়স পাঁচ বৎসর, তখন গুণবন্ত রাও বিবাহ করেন। দুই-তিন বৎসর পরে তাহার এক কন্যা হয়, তিনি এই কন্যার নাম রাখিয়াছিলেন, চন্দন বাঈ। চন্দন বাঈ ও আমি ভ্রাতা-ভগিনীর ন্যায় এক সঙ্গে লালিতপালিত হইয়াছিলাম। বলা অধিক, যে আমি প্রাণ অপেক্ষাও চন্দনকে ভালবাসিতাম।
যখন তাহার বয়স বার বৎসর, তখন মহা সমারোহে গুণবন্ত রাও আমার সহিত চন্দনের বিবাহ দিলেন। আমার সুখের মাত্রা পূর্ণ হইল। আমি জানিতাম, আমার ন্যায় সুখী আর ত্রিজগতে কেহ ছিল না। কিন্তু আমার অদৃষ্টে যে এ দুর্দশা ঘটিবে, কে জানিত! আমার চন্দনের যে পরিণামে কি ঘটিবে, তাহা আমি তখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। চার পাঁচ বৎসর আমরা বড়ই সুখে কাটাইলাম।
এই সময়ে আমাদের জমীদারের মৃত্যু হইল। পাপাত্মা বালকিষণ আমাদের সর্দার হইল। আমাদের পূর্বের সর্দার মহাত্মা লোক ছিলেন, তাঁহার দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রশংসা সকলেই করিত; কিন্তু এই দুরাত্মার নিন্দা চারিদিকেই শীঘ্র বিকীর্ণ হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, বালকিষণ মহা দুর্দান্ত,-অর্তি পাশব চরিত্র লম্পট,-দয়ামায়া তাহার হৃদয়ে একেবারেই নাই। সে নানা প্রকারে তাহার প্রজা দিগের উপর অত্যাচার করিতে লাগিল। তাহার অত্যাচারে অনেকেই ঘরবাড়ী ছাড়িয়া অন্যত্রে পলাইতে লাগিল।