ত্রিম্বক রাও বলিল, আমি কোন বিষয়ের জন্যই আর ভীত নই। আমি স্বীকার করছি, পা ও রং ও সর্দার বুলকিষণকে খুন,আমিই করেছি—নিজহস্তে।
সাহেব। ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকার করবে?
ত্রিম্বক। কেন করব না। এই দুই দুরাত্মাকে খুন করে মরু বলেই ত খুন করেছি।
সাহেব। কেন খুন করলে? ত্রিম্বক। সে অনেক কথা। জগতের লোক না মনে করে যে আমি অন্যান্য খুনীর মত নরাধম। তাই সকল কথা লিখে রেখে যাব মনে করেছি। আপনারা কি অনুগ্রহ করে আমাকে কালি কল কাগজ হাজতে দিবেন? আমি আমার সমস্ত বিবরণ লিখে রাখুন। এই দুই পাপাত্মা আমার সর্বনাশ করেছিল, তাই এদের উপযুক্ত সাজা দিয়াছি।
সাহেব। এ সব কথা বিচারের সময় বলতে পার।
ত্রিম্বক। বিচার পর্যন্ত বাঁচব না।
সাহেব আসামীর মুখের দিকে চাহিলেন। ত্রিম্বক বলিল, ভয় নাই সাহেব, আত্মহত্যা করে পাপ করব। আমার যে ব্যারাম হয়েছে, তাতে আর আমি বেশি দিন বাঁচব না। কেবল বেঁচে ছিলাম, প্রতিহিংসা সাধনের জন্য। তা হয়েছে।
সাহেব আমাদের সকলের দিকে চাহিলেন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার বন্ধু একজন ডাক্তার। একবার আসামীকে পরীক্ষা করিতে ক্ষতি কি?
সাহেব বলিলেন, আপনি ভালই বলেছেন।
তখন সাহেবের অনুরোধে আমি ত্রিম্বক রাওকে বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিলাম, আসামী ঠিকই বলছে। এর রক্তপিত্তের উপর যক্ষ্মা রোগ হয়েছে, সুতরাং কোন কারণে মন উত্তেজিত হলে,এর সহসা মৃত্যু হওয়া সম্ভব।
সাহেব ত্রিম্বক রাওয়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তোমাকে হাজতে কালি কলম কাগজ দেওয়া যাইবে। সমস্ত বৃত্তান্ত আমাদের জানা আবশ্যক। তৎপরে রাম সিংএর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, এখনই আসামীকে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাও। তার সম্মুখে স্বীকার পত্রে এর সহি করা আবশ্যক। তার পরে আসামীকে হাজতে রেখে কালি কলম কাগজ দিয়ো। আমাদিগকে বলিলেন, আপনারা কাল এগারটার সময় আদালতে হাজির থাকবেন।
আসামীকে লইয়া আমরা সকলে বাহিরে আসিলাম। গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, একটা কথা তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা করবার আছে।
ত্রিম্বক। বলুন—কি।
গোবিন্দ। ইয়ারিং নিতে এসেছিল কে?
ত্রিম্বক। আমিই। ছেলে বেলা থেকে বহুরূপী সাজা আমার অভ্যাস ছিল। এই দুই দুরাত্মাকে সাজা দেবার জন্য আমাকে অনেক সাজেই সাজতে হয়েছে। দেখুন, আপনার মত লোকের চোখেও ধূলা দিয়েছিলাম।
গোবিন্দ। স্বীকার করি, তোমার বাহাদুরী আছে।
ত্রিম্বক। আপনারও বাহাদুরী খুব।
রাম সিং আসামীকে লইয়া হাজতের দিকে গেলেন। আমরাও বাসায় ফিরিলাম।
একাদশ পরিচ্ছেদ।
সেইদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গোবিন্দ বাবুর সহিত অনেক কথা বার্তা হইল। আমি বলিলাম, প্রকৃতই আপনি অদ্ভুত ক্ষমতাপন্ন লোক। আপনি পূর্বে যা যা বলেছিলেন, এখন দেখছি সকলই ঠিক।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এ ব্যাপারে কিছুই কঠিন ছিল না।
আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, কঠিন কিছুই ছিল না, বলেন কি!
গোবিন্দ। হাঁ, সামান্য বিবেচনা শক্তি ব্যবহারে আমি তিন দিনের মধ্যে জানতে পেরেছিলাম, আসামী কে?
আমি। সে কথা সত্য। আপনি পূৰ্বে এ কথা বলেছিলেন।
গোবিন্দ। এ রকম ব্যাপারের রহস্যভেদ করতে হলে উল্টা দিকে বা পিছন দিকে বিচার করে যাওয়াই উচিত। লোকে সাধারণত তা করে না-সমুখ দিকেই দেখে। মেঘ হয়েছে, বাতাস বন্ধ হয়েছে, খুব গুমট বোধ হয়েছে, এই সকল বিবেচনা করে লোকে বলে শীঘ্র বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হয়ে গেলে কে ভাবে যে, কি কি ঘটনার সংযোগে বৃষ্টি হল। ফল দেখে সেই ফল কিসে ফল তা কয় জন ভাবে?
আমি। আমি আপনার কথার ঠিক ভাবার্থ বুঝতে পারুলেম না।
গোবিন্দ। এই খুনের ব্যাপারটিই ধরুন। আমি দেখলেম,
গোবিন্দরাম। একটা ঘটনার ফল, এই এক বা দুই খুন। কেন খুন হল, আর কে খুন করিল, এই আমাকে জানতে হবে। আমি উল্টা দিকে বিচার করতে আরম্ভ করলেম। আগেই বলেছি, গাড়ীর চাকার আর পায়ের দাগ, ঘরের অবস্থা দেখে আমি কতক স্থির করি। যা যা স্থির করে ছিলাম, তা আপনাকে ও রামসিংকে সেদিন বলেছিলাম।
আমি। হাঁ, বলেছিলেন বটে।
গোবিন্দ। জেনেছিলাম দুটা লোক একখানা এক্কায় এসে এই বাড়ীটায় যায়; একজন আর একজনকে বিষ খাইয়ে মারে। এখন এ লোকটা কে? জানেন, নাসিকে আমি টেলিগ্রাফ করি।
আমি। হাঁ, আমি ত সঙ্গেই ছিলাম।
গোবিন্দ। উত্তরে জানলাম, বালকিষণ রাও একজন বড় সর্দার। তার নামে ত্রিম্বক রাও নামে একটা লোক স্ত্রী ছিনিয়া লওয়ার জন্ম পুলিশে নালিশ করে। পুলিশ বড় লোকের দাসানুদাস, ত্ৰিম্বককে হাঁকাইয়া তাড়াইয়া দেয়। তার পর এই বালকিষণ রাই আবার পুলিশে খবর দেয় যে, ত্রিম্বক তাকে খুন করবার চেষ্টায় আছে। তখন কি বোঝ শক্ত যে ত্ৰিম্বকই এই খুন করেছে।
আমি। নিশ্চয়ই নয়।
গোবিন্দ। এ কথা আরও সপ্রমাণ হল পাণ্ডুরাংয়ের পকেটের টেলিগ্রাফ দেখে। তাতে লেখা—সাবধান, ত্রিম্বক লাহোরে। এই দুইটা লোক টেলিগ্রাফ পেয়েই ভয়ে লাহোর থেকে পালাইয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভগবান দুষ্টের দমনের জন্য তা হতে দিলেন না।
আমি। আপনি ঠিক বলেছেন।
গোবিন্দ। আমি আগে দেখেছিলাম,এক্কায় দুজনের অধিক শো ছি–তা এowথা চিল না। নাগরা তা দেখে বললেন
গোবিন্দরাম।
এক্কাওয়ালা হয়েছে। ইহাই খুব সম্ভব, কারণ একা হলে যত সহজে একজনের পেছনে পেছনে থাকা যায়, পায়ে হেঁটে তা হয় না।