তিনি অপর বড়ীটার অর্ধেক কাটিয়া পূর্বের ন্যায় জল ও দুগ্ধের সঙ্গে মিশাইলেন; পূর্বের ন্যায় কুকুরকে পান করিতে দিলেন। সে পান করিবামাত্র বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল, তখনই মাটিতে পড়িয়া ছট ফটু করিতে লাগিল। ক্ষণপরে আমরা সকলে তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া দেখিলাম, কুকুর মরিয়া আড়ষ্ট হইয়াছে।
তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই বড়ীতেই মারাঠীর প্রাণ গিয়াছে।
আমি বলিলাম, একটা বিষাক্ত আর একটা অব্যিক্ত বড়ী রাখবার মানে কি?
গোবিন্দ। এখন ঠিক বলতে পারি না। তবে বোধ হয়,যে লোক এই বড়ী এনেছিল, সে নিজে জোর করে বিষ-বাড়ী খাওয়ায় নাই। লোকটা দুটা বড়ার একটা নিজে বেছে নিয়ে তাকে খেতে বলেছিল। যে কোন কারণে হো, লোকটা অনিচ্ছাসত্ত্বে একটা বড়ী খেতে, বাধ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য বশতঃ ভগবান্ পাপীর দণ্ডের জন্য তাকে দিয়া এই বিষ বড়ই তাকে খাইয়েছিলেন।
সূরযমল বলিলেন, আপনি কি প্রকৃতই এই খুনের সমস্ত ব্যাপার জানতে পেরেছেন।
গোবিন্দ। নিশ্চয়—কেবল জানা কেন, আমি তার নাম পর্যন্ত বলতে পারি।
রাম। তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে তিলার্ধ দেরী করা উচিত নয়।
গোবিন্দ। নাম জানা যত সহজ, তাকে গ্রেপ্তার করা ঠিক ততটা সহজ নয়। আমি এখন আপনাদিগকে সব কথা বলতে পারি না—হয় ত তাতে তাকে গ্রেপ্তার করা সহজ না হতেও পারে। এমন কি তাড়াহুড়ো দিলে সে এ সহর ছেড়ে পালাতেও পারে।
আমি। কিন্তু সে আরও ত খুন করতে পারে।
সূরয। ডাক্তার বাবু ঠিক বলেছেন।
গোবিন্দ। সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, সে আর কাকেও খুন করবে না। আমি তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য যে বন্দোবস্ত করেছি, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই কাজ সফল হবে। তখন আপনাদের সব খুলে বলব। এখন আমাকে আপনারা মাপ করুন। একদিন চব্বিশঘণ্টা মাত্র চুপ করে থাকুন।
সূরয। আমরা দুজনই যখন এর কিছুই এ পর্যন্ত কিনারা করতে পারি নাই, তখন আমরা চুপ করে না থেকে আর কি করব?
গোবিন্দ। রাগ করবেন না। শীঘ্রই আসামী গ্রেপ্তার হবে।
তবে এখন আমরা বিদায় হই, আবার দেখা করব, বলিয়া পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উঠিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ।
এই সময়ে সহসা তথায় সেই ননীয়া বালক উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া গোবিন্দ বাবু পুলিশ-কৰ্ম্মচারীদ্বয়কে বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন। তাহারা উঠিয়াছিলেন, বসিলেন। তখন গোবিন্দ বাবু ননীয়াকে বলিলেন, তবে ননীয়া, খবর কি?
ননীয়া! হুজুর, একা দরজায়।
গোবিন্দ! বেশ ননীয়া,—তাকে একবার এইখানে ডাক,—সে আমার জিনিষ গাড়ীতে তুলুক।
গোবিন্দ বাবু কোন্খানে যে যাইবেন, তাহা তিনি আমাকে বলেন নাই, সুতরাং তাহার কথা শুনিয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম; কিন্তু কোন কথা কহিলাম না। গোবিন্দ বাবু একটা নুতন ধরণের হাতকড়ী বাহির করিয়া বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনারা এই নুতন ধরণের হাতকড়ী চলতি করেন না কেন? দেখুন দেখি, এ কেমন স্প্রিং দেওয়া,—এক সেকেণ্ডে পরিয়ে দেওয়া যায়।
রাম সিং বলিলেন, পুরাণতেই কাজ চলতে পারে—যদি পাইবার লোক পাওয়া যায়।
এই সময়ে ননীয়া, এক্কাওয়ালাকে লইয়া তথায় উপস্থিত হইল। তখন গোবিন্দ বাবু নিজ পোর্টম্যান্ট আঁটিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। তিনি এক্কাওয়ালাকে বলিলেন, এস দেখি বাপু, এইটা একটু চেপে ধর, এটাকে এঁটে নি।
সে আসিয়া পোর্টম্যান্টটি চাপিয়া ধরিল। পরমুহূর্তেই ক্রিং করিয়া একটা শব্দ হইল। গোবিন্দ বাবু লম্ফ দিয়া দণ্ডায়মান হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই নিন্ আপনাদের খুনী, ত্রিম্বক রাও খণ্ডেকার। আমরা তিনজনই লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। এক্কাওয়ালাও লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। দেখিলাম, তাহার হাতে হাতকড়ী। সে একবার সবলে হন্তস্থ হাতকড়ী ভাঙ্গিবার চেষ্টা পাইল, পরে দ্বারের দিকে চাহিল; বোধ হইল যেন পলায়নের উদ্যম করিল। কিন্তু রাম। সিং ও রমল লম্ফ দিয়া তাহার গলার কাপড় ধরিয়া তাহাকে টানিয়া গৃহের এক কোণে ফেলিলেন। অমনি সেই ব্যক্তির মুখ ও নাক দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িতে লাগিল। সে কাপড়ে রক্ত মুছিয়া ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। পালাবার ইচ্ছা রেখে খুন করি নাই।
গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, তবে আমার অনুমান মিথ্যা নহে; লোকটার রক্ত পিত্তের ব্যারাম ও ঠিক।
খুনী ত্ৰিম্বক রাও বলিল, আপনার বাহাদুরী আছে। আপনি আমাকে ধরায় আমি অসন্তুষ্ট নই।
রাম সিং বলিলেন, আর দেরী করা নয়। চলুন আসামীকে নিয়ে থানায় যাই।
সূরয। ঠিক কথা,-পরে গোবিন্দ বাবুর কাছে সব শুনব।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বেশ কথা, তাই চলুন। তৎপরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ডাক্তার মহাশয় ও আসুন; আপনি এই মাল্লার গোড়া থেকেই আছেন।
সূরবমল ও রাম সিং আসামীর গলার কাপড় তখনও ছাড়েন নাই। ত্ৰিম্বক রাও হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। ছেড়ে দিন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ছেড়ে দিলে পালাবে না।
তখন ত্ৰিম্বক রাওয়ের এক্কায় রাম সিং তাহাকে লইয়া উঠিলেন। সূরযমল হাঁকাইয়া চলিলেন। আমি ও গোবিন্দ বাবু আর একখানা এক ডাকিয়া তাহাতে চড়িয়া বসিলাম।
থানায় আসিয়া আমরা সকলে আসামীকে সইয়া সুপারিন্টেন্টে সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। তিনি আসামী গ্রেপ্তারের সকল বিবরণ রাম সিং সাহেবের নিকট শুনিয়া এক রাওয়ের দিকে চাহিলেন। তৎপরে বলিলেন, তোমার কিছু বলবার আছে? তুমি কি এই দুই খুন করেছ? ত্রিম্বক কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সাহেব তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, তোমাকে আমার সাবধান করে দেওয়া উচিত। জেন, এখন তুমি যা বলবে, আমি সমস্তই লিখে রাখব। বিচার সময়ে তোমার কথা তোমারই বিরুদ্ধে প্রাণরূপে ব্যবহৃত হবে। যা বল্বে, বুঝে বল্বে।