গোবিন্দ। রক্ত?
সূরয। পুলিশের চোখে ধূলা দেবার জন্য মুর্গী-টুগী একটা যা হয় কিছু কেটে ঘর ময় রক্ত ছড়িয়ে গেছে।
গোবিন্দ। গোকুলপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করাতে সে কি বলে?
সূরয। সে প্রথমেই বলে উঠল, বোধ হয়, আপনারা সেই মারাঠীর খুনের জন্য আমায় গ্রেপ্তার করছেন। আমরা, হ, বলায় সে বলে,আমি খুন করি নাই, আমি এর কিছুই জানি না। আমি তাকে তাড়া করায় সে একখানা একায় চড়ে পালিয়ে যায়? হা-হা-হা, খুব সাদা কথা। কোন আদালত এ কথা বিশ্বাস করবে না।
এই সময়ে রাম সিংহের তথায় অভ্যুদয় হইল। আমরা সকলেই তাহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ভায় আসামী যে গারদে।
রাম সিং বলিলেন, আসামীর সাজা হবে, তবে ত খুনের কিনারা হবে। শুধু গ্রেপ্তারে কি হয়?
সূরয। কেন?
রাম। কেন? এই তোমার গোকুলপ্রসাদ কি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংকেও খুন করেছে ?
আমরা সকলেই অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত বলিয়া উঠিলাম,সে কি?
রাম নিং বলিলেন, হাঁ, শঙ্কররাম পাণ্ডুরাংও খুন হয়েছে। তার লাস মোসাফের-খানায় পড়ে আছে। তারও ঘরের দেয়ালে রক্তে লেখা সাজা।
আমরা সকলই স্তম্ভিত হইলাম। সূরযমল এরূপ ভাবে বিস্ফারিত নয়নে রাম সিংহের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন যে, তাহাকে দেখিলে প্রকৃতই বড় কষ্ট হয়; যেন তিনি সাত হাত উপর থেকে একেবারে স্নাত হাত মাটীর নীচে বসিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এই করুণরসাভিনয়ে কিছু মাত্র মনোযোগ না দিয়া গোবিন্দ বাবু হো হো শব্দে উচ্চৈস্বরে হাসিয়া উঠিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ।
ইহাতে পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উভয়েই যে বিশেষ বিরক্ত হইলেন, বলা বাহুল্য। গোবিন্দ বাবুও যে তাহা বুঝিলেন না, এমনও নহে। বলিলেন রাগ করিবেন না, আমার বাচালতা ক্ষমা করিবেন। এখন রাম সিং সাহেব যে আশ্চৰ্যজনক সংবাদ দিলেন, তাহার বিষয় সব শোনা যাক।
সূরমল বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কি এ সংবাদ ঠিক পেয়েছেন?
রাম। ঠিক পাওয়া-পায়ি কি দাদা-আমি নিজে মসাফের-থানায় গিয়ে স্বচক্ষে তার লাস দেখে এসেছি।
গোবিন্দ। আচ্ছা, সব ব্যাপারটা শোনা যাক।
রাম। মান গেল মনে বিশ্বাস হয়ছিল যে এখন এই মারাঠীর বন্ধুই করেছে,এ আমি স্বীকার করি। আমি তাই তখন হতেই লোকটার সন্ধানে থাকি। পিয়নের কাছে ঠিকানা পেয়ে আমি গোকুল প্রসাদের বাড়ী যাই, কিন্তু ঐ বাড়ীর পাশের দোকানীর কাছে খবর পাই যে মারাঠী দুজন তাদের জিনিষ পত্র নিয়ে ষ্টেশনে চলে গেছে। তখন আমি ষ্টেশনে গিয়ে সন্ধান করি। কুলীর বলে যে, হাঁ, দুজন মারাঠী রাত্রি আটটার পর ষ্টেশনে এসেছিল, তারা তাদের জিনিষ-পত্ৰ মামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ভারি মাতাল, সে অপরের সঙ্গে বকাবকি করে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। অপর মারাঠী তার জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে, গাড়ীর সময়েও কিন্তু সে ফেরে না। তখন সেই মারাঠী মুটেদের জিনিষপত্র নিয়ে তার সঙ্গে ষ্টেশনের সম্মুখের মোসাফের-খানায় যেতে বলে। তারা জিনিষ-পত্র নিয়ে সেইখানে রেখে আসে। মারাঠীও সে রাত্রের জন্য মোসাফের-খানায় বাসা নেয়।
সূরয। তার পর?
রাম। তার পর আমি এই খবর পেয়ে তখনই মোসাফের থানায় যাই। সন্ধানে জানি যে সত্যই একজন মারাঠী ভদ্রলোক কাল অনেক রাত্রে মোসাফের-খানায় বাসা নিয়েছিল; কিন্তু এখন তিনি কোথায়, কেউ সে কথা বলতে পারে না দেখে, আমি মোসাফের থানায় দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে উপরে গিয়া দেখি, একটা ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক ঠেলাঠেলিতে কেহ দরজা না খোলায় আমি দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি। ভিতরে গিয়ে দেখি, মারাঠীর মৃতদেহ পড়ে আছে। তার বুকে কে ছোরা মেরেছে। যে ছোরা মেরেছিল, সে বিছানার চাদরে ছোরার রক্ত মুছেছে, পাশের লোটার জলে হাত ধুয়েছে, আর দেয়ালে রক্তে লিখে গেছে সেই, সাজা।
আমি বলিয়া উঠিলাম, কি ভয়ানক!
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আর কিছু দেখিলেন?
রাম। লাসের পকেটে ছাপান্নটা টাকা ছিল,আর একখানা টেলিগ্রাফ।
গোবিন্দ। টেলিগ্রাফে কি লেখা ছিল?
রাম। নাসিকের বামন রাও লাহোরে পাণ্ডুরাংকে টেলিগ্রাফ করছে। ত্ৰিম্বক লাহোরে গিয়াছে। সাবধান।
গোবিন্দ। আর কিছু?
রাম। হাঁ, একটা কৌটা, আর তাতে দুটা বড়ী।
গোবিন্দ বাবু বিদ্যুদ্বেগে লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন—কোন নিরন্ন ভিক্ষুকও সহসা লক্ষ টাকার সমাগমে এতখানি আনন্দ প্রকাশ করে না। গোবিন্দ বাবু খুব ৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, হে হহ হে, আমার কেস এতক্ষণে সম্পূর্ণ হল। আমি যা খুঁজছিলাম, এতক্ষণে তাই পেয়েছি।
তাঁহার তাবগতিক দেখিয়া আমরা সকলেই আশ্চর্যান্বিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল বলিলেন, আপনি ক্ষমতাপন্ন লোক সন্দেহ নাই, সেইজনা আপনাকে সম্মান ও ভক্তি করি, কিন্তু আপনার কোন কথায়ই আমরা বুঝতে পারছি না।
গোবিন্দ। শীঘ্রই সব বুঝিয়ে দিব। এখন রাগ করবেন না। রামসিং সাহেব, সে কৌটাটা হস্তগত করেছেন ত?
রাম। হাঁ, এই যে সঙ্গেই এনেছি।
গোবিন্দ। দিন, একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।
গোবিন্দ বাবু কৌটা হইতে একটা বড়ীর আধখানা কাটিয়া তাহা জলে লিলেন। তৎপরে তাহাতে একটু দুধ মিশাইয়া রাস্তার একটা জীর্ণ মীd না তা পান করিতে দিলেন। ক্ষুধার্ত কুকুর তাহা তৎক্ষণাৎ খাইয়া ফেলিল। গোবিন্দ বাবু উৎসুক হৃদয়ে সেই কুকুরটাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই কুকুরের কিছুই হইল না, সে আরও দুগ্ধ পাইবার জন্য মুখ তুলিয়া ঘন ঘন লাল আন্দোলন করিতে লাগিল। তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আশ্চৰ্য্য বটে। আমার কি ভুল হবে? কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, আমি কি গাধ—একেবারে নিরেট! এমন সহজ কথাটাও একবার আগে মনে পড়ে নাই।