- বইয়ের নামঃ গোবিন্দরাম
- লেখকের নামঃ পাঁচকড়ি দে
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১ম খণ্ড – ডাক্তারের কথা
গোবিন্দরাম (ডিটেকটিভ উপন্যাস)
বিজ্ঞাপন
একই গ্রন্থকারের ইংরাজী ভাষায় দুইখানি সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ উপন্যাসের ছায়াবলম্বনে গোবিন্দরাম সঙ্কলিত। ইহা সঙ্কলন করিতে আমাকে সর্বত্র বড়ই স্বাধীনতা প্রকাশ করিতে হইয়াছে। মূলগ্রন্থ হইতে বাহুল্য বোধে অনেকস্থান পরিবর্জিত হইয়াছে; কোন কোন স্থান একেবারে স্বকোপলকল্পিত। ইহাতে যদি কোন দোষ হইয়া থাকে, তাহা আমারই। আর যদি আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ এই উপন্যাসখানি প্রীতনেত্রে দেখেন, তাহা হইলে আমার সকল শ্রম সার্থক হইবে।
গ্রন্থকার।
গোবিন্দরাম।
প্রথম খণ্ড। (ডাক্তারের কথা।)
প্রথম পরিচ্ছেদ। ডাক্তারী পাস করিয়া দিন-কতক উপার্জনের চেষ্টায় রহিলাম, কিন্তু কোন দিকে কোন সুবিধা না হওয়ায়,-এবং গৃহেও অর্থ প্রচুর পরিমাণে থাকায়, অবশেষে সরকারী চাকরী লইয়া পশ্চিমে রওনা হইলাম।
কয়েক মাস নানাস্থানের হাসপাতালে চাকরী করিয়া আমি বদলী হইয়া রাওলপিণ্ডি আসিলাম। তথায় ১৭নং শিখ-পদাতিদলের হাসপাতালের ভার পাইলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ শীঘ্রই কাবুল যুদ্ধ বাধিল। ১৭ নং শিখ-পদাতি যুদ্ধের জন্য কাবুলের দিকে রওনা হইল; আমিও বাধ্য হইয়া ঐ পল্টনের সহিত চলিলাম।
প্রায় বৎসরাবধি আফগানিস্থানে থাকিয়া নানা ক্লেশে ও অত্যধিক পরিশ্রমে আমার শরীর একেবারে ভগ্ন হইয়া গেল। অনেক কষ্টে ছুটি পাইয়া দেশে ফিরিবার ইচ্ছা করিলাম; কিন্তু সকলেই বলিল, দেশে ফিরিলে বাঁচিবে না। দিনকতক পাঞ্জাবে থাকিয়া শরীরটা সারিয়া তবে দেশে যাইয়ো। আমিও মনে মনে ইহাই স্থির করিলাম। আগে দিন-কতক লাহোরে থাকিয়া শরীরকে সুস্থ করিয়া পরে দেশে যাইব, স্থির করিয়া লাহোরে আসিলাম।
অপরিচিত স্থানে কোথায় যাই, কি করি, কোথায় বাসা স্থির করি, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে আমি চকে আসিলাম; অন্যমনস্ক ভাবে চারিদিকে চাহিতেছি, এমন সময়ে সহসা পাদ্দিক হইতে কে আমার ঋন্ধে হস্ত স্থাপন করিয়া বলিল, ডাক্তার বসু যে!
আমি চমকিত হইয়া ফিরিলাম। দেখিলাম, আমার রাওলপিণ্ডির বন্ধু রামেশ্বর প্রসাদ। ইনি রাওলপিণ্ডিতে ওকালতী করিতেন; আমার সহিত বিশেষ বন্ধুত্ব হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, অপরিচিত স্থানে একটি পূর্ব বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইয়া আমার হৃদয়ে বিশেষ আনন্দের সঞ্চার হইল।
বন্ধু বলিলেন, কাবুল হতে কবে ফিরিলে হে? মনে করিয়া এ অধমকে কি একখানা চিঠি লিখিতেও নাই?
আমি বলিলাম, পল্টনের সঙ্গে গেলে যে কি অবস্থায় থাকতে হয়, তাহা যাহারা না গিয়াছে তাহারা বুঝিবে না। দেখিতেছ ত আমার অবস্থা।
তিনি বলিলেন, তাই ত, একেবারে যে অস্থিচর্মসার হয়েছ? দিনকতক এ দেশে থেকে শরীর ভাল না করে দেশে যেয়ো না।
আমি বলিলাম, তাই কিছুদিন লাহোরে থাক্ব বলে এসেছি। ছ মাসের ছুটিও পেয়েছি।
তিনি। কোথায় থাকবে?
আমি। একটা বাসা খুঁজছি। অচেনা জায়গা, তাতে শরীর বড় খারাপ। একটা মনের মত জায়গা না হলে বড় কষ্ট পেতে হবে। লাহোরে তোমার ত সবই চেনা-শোনা আছে। আমাকে একটা ভাল বাসা ঠিক করে দাও দেখি।
তিনি। কি আশ্চর্য! আজ আর একজনও আমাকে বাসা খুঁজে দিতে বলছিলেন।
আমি। তিনি কে?
তিনি। তিনিও বাঙ্গালী। সম্প্রতি লাহোরে বেড়াতে এসেছেন। দিন-কতক-এখানে থাকবেন। বোধ হয়, কিছু কাজ-কর্ম আছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে তোমার পোযাবে কি না, সেটা ঠিক বলতে পারি না।
আমি। কেন?
তিনি। লোকটার অনেক রকম খেয়াল আছে বলে, বোব
আমি। তা থাক, একলা থাকার চেয়ে দুজনে থাকলে অনেকটা ভালই কাটবে।
তিনি। তবে চল, তার সঙ্গে তোমার আলাপ করে দিই। আমার সন্ধানে একটা বেশ ভাল ছোট বাড়ী আছে। তোমাদের দুজনের থাবার পক্ষে সেটি বেশ হবে।
আমি। তিনি এখন কোথায় আছেন?
তিনি। মসাফেরখানায় আছেন।
আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, মসাফেরখানায়! তিনি বলিলেন, হাঁ, আলাপ হলেই বুঝবে। তবে পোয় পোষায় সে তুমি বুঝে নিয়ে।
আমরা উভয়ে তখন মসাফেরখানার দিকে চলিলাম। তথায় আসিয়া দেখিলাম, একটি বাঙ্গালী ভদ্রলোক কতকগুলি বোতল, শিশি আরক লইয়াই বড় ব্যতিব্যস্ত। আমাদের পদশব্দে তিনি চকিতে একবার মস্তক তুলিলেন। মহেশ্বর প্রসাদকে দেখিয়া বলিলেন, আসুন, আসুন, কি সৌভাগ্য!
মহেশ্বর প্রসাদ বলিলেন, আগে আপনাদের দুজনের পরিচয় করিয়া দিই। ইনি আপনাদেরই দেশের লোক, ডাক্তার বসু। তৎপরে তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, গোবিন্দ বাবু আমার বিশেষ বন্ধু।
তখন গোবিন্দ বাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া আমার হস্ত সবেগে বিলোড়ন করিয়া বলিলেন, কাবুল থেকে কবে ফিরিলেন?
আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কিরূপে জানিলেন যে, আমি কাবুলে গিয়াছিলাম?
তিনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন,সে কথা থাক্,আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড়ই সুখী হলেম। দেশের লোক–বিদেশে দেখা হলে স্বভাবতঃই বড় আনন্দ হয়।
মহেশ্বর বাবু বলিলেন, আপনি বাসা খুঁজছিলেন,ইনিও খুঁজছেন। আমি একটা ছোট বাড়ী ঠিক করেছি, সেখানে আপনারা দুজনে খুব ভালই থাকবেন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আরও ভাল, তবে একসঙ্গে থাবার আগে দুএকটা কথা হওয়া ভাল। আমি তামাকটা বড় ঘন ঘন খাই—চুরুট ত সৰ্ব্বদা মুখেই থাকে—আপত্তি আছে কি?