তিনিই তো নাম মিলিয়ে নেন?
হ্যাঁ।
তবে আগে চলুন বিমলবাবুর খোঁজটা নেওয়া যাক, তিনি হয়ত এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
চলুন।
শীতের সকাল। পথের দুপাশের কচি দুর্বদলগুলির গায়ে রাতের শিশির বিন্দুগুলি সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই খনির সীমানা পড়ে। ট্রাম লাইনের পাশে একটা শূন্য কয়লা গাড়ির চারদিকে একদল সাঁওতাল জটলা পাকাচ্ছে, সকলেরই মুখে একটা ভয়চকিত ভাব।
শংকরকে আসতে দেখে দলের মধ্যে একটা মৃদু গুণগুণ ধ্বনি জেগে উঠল।
কুলীদের সর্দার রতন মাঝি এগিয়ে এল।
কি খবর মাঝি? কিছু বলবি?
আমরা আর ইখানে কাম করতে লারব বাবু।
কেন রে?
ই খনিতে ভুত আছে বাবু। ভূত।
ওসব বাজে কথা, তাছাড়া কাজ ছেড়ে দিলে খাবি কি?
কিন্তুক তুরাই বল কেনে বাবু। প্ৰাণটি হাতে লিয়ে এমনি করে কেন্নে কাজ করি?
চন্দন সিং ও বিমলবাবু এসে হাজির হলেন।
এই যে বিমলবাবু, কাল রেজিস্ট্রী খাতা। আপনি মিলিয়ে ছিলেন তো? শংকর প্রশ্ন করল।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সকলে খাদ থেকে উঠে এসেছিল working hours-য়ের পরে-মানে, যারা কাল দিনের বেলায় কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিল তারা সকলে আবার খাদ থেকে ফিরে এসেছিল তো?
তা এসেছিল বৈকি!
তবে এইরকম দুর্ঘটনা ঘটলো কি করে? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই। চানিক যে চালায় সে লোকটা কোথায়?
কে, আবদুল?
হ্যাঁ।
সে চানক এর মেসিনের কাছেই আছে।
তাকে একবার ডেকে আনুন।
বিমলবাবু আবদুলকে ডাকতে চলে গেলেন।
রতন মাঝি আবার এগিয়ে এল। বাবু, আমরা কুলিকামিনরা আজ চলে যাবো রে।
তোদের কোন ভয় নেই। দুটো দিন সবুর কর, আমি সব ঠিক করে দেবো। ভূতটুত ওসব যে একদম বাজে কথা এ আমি ধরে দেবো। যা তোরা যে যার কাজে যা।
কিন্তু দেখা গেল। শংকরের আশ্বাস বাক্যেও কেউ কাজে যাবার কোন গরজই দেখাচ্ছে না।
তু কি বলছিস বাবু, আমি বোঙার নামে কিরা কেটে বলতে পারি এ খনিতে ভূত আছে।
এমন সময় বিমলবাবু আবদুল মিস্ত্রিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
আবদুলকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত সন্ধ্যায়। সে যথারীতি আটটার মধ্যেই চানক বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং যতদূর জানে খাদে আর কেউ তখন ছিল না।
চানিকের এনজিনে চাবী দেওয়া থাকে না মিস্ত্রি?
জিজ্ঞাসা করল সুব্রত।
হ্যাঁ সাব।
চাবী কার কাছে থাকে?
আজ্ঞে আমার কাছেই তো।
আচ্ছা, আজ সকালে চানিকের। এনজিনের কাছে গিয়ে এনজিনে চাবী দেওয়া দেখতে পেয়েছিলে তো?
হ্যাঁ সাব।
চলুন শংকরবাবু, খাদের যে কাঁথিতে পিলার ধ্বসে গেছে সে জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসি।
বেশ চলুন। আসুন বিমলবাবু, চল চন্দন সিং।
তখন সকলে মিলে খাদের দিকে রওনা হলো।
নেকড়ার পুটলি
এক, দো, তিন!!
কয়লা খাদের মুখে অনুসেটার ঘণ্টা বাজালে, এক, দো, তিন।
ঠং ঠং ঠংl… ঘণ্টার অদ্ভুত আওয়াজ এক, দো, তিন বলবার সঙ্গে সঙ্গে গম গম ঝন ঝন করে চানকের গহ্বরের স্তরে স্তরে প্রতিধ্বনিত হলো।
পাতালপুরীর অন্ধ-গহ্বর থেকে যেন মরণের ডাক এলো, আয়! আয়! আয়!
এ যেন এক অশরীরী শব্দমুখর হাতছানি।
রেজিং বাবু রামলোচন পোদ্দার চানকের মুখে আগে এসে দাঁড়াল।
তিনটি ঘণ্টার মানে মানুষ এবারে খাদে চানকের সাহায্যে নামবে তারই সংকেত।
চানকের রেলিং ঘেরা খাঁচার মত দাঁড়াবার জায়গায় শংকর, রেজিং বাবু, সুব্রত, রতন মাঝি ও আরো দুই জন সর্দার গ্যাসল্যাম্প নিয়ে প্রবেশ করল।
অন্ধকার গহ্বর পথে ঘড়ি ঘড় শব্দে চানক নামতে শুরু করল।
বাইরের রৌদ্রতপ্ত পৃথিবী যেন সহসা সামনে থেকে ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
উপরের সুন্দর পৃথিবী যেন খাদের এই বীভৎস অন্ধকারের সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে দূরে সরে গেছে।
সকলে এসে খাদের মধ্যে নামল।
কঠিন স্তব্ধ অন্ধকার। কালো কয়লার দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মিশে এক হয়ে গেছে।
মৌন আঁধারে, মধ্যে শীতটা যেন আরো জমাট বেঁধে উঠেছে। সর্দার তিনজন গ্যাসল্যাম্প হাতে এগিয়ে চলল পথ প্ৰদৰ্শক হয়ে, অন্য সকলে চলল। পিছু পিছু। সম্মুখে ও আশপাশে কালো কয়লার দেওয়ালে সামান্য যেটুকু আলো গ্যাসল্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তা ছাড়া চারিদিকে কঠিন মৌন অন্ধকার যেন কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় হাঁ করে গিলতে আসছে। সকলের পায়ের শব্দ অন্ধকারের বুকে শুধু যেন জীবনের একমাত্র সাড়া তুলেছে। এবং মাঝে মাঝে দু একটা কথার টুকরো তার কাটা কাটা শব্দ।
সহসা রতন মাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াল।
১৩নং কাঁথিতে যাবার মেন গ্যালারী এইটাই না হে মাঝি? প্রশ্ন করলেন বিমলবাবু।
আজ্ঞে বাবু—
চালটা এখানে একটু খারাপ আছে না?
আজ্ঞে।
এখানে একটু সাবধানে আসবেন ম্যানেজারবাবু। এ পাশের লোকেশনটার কি ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখেছেন স্যার? শংকর নীরবে পথ চলতে লাগল। বিমলবাবুর কথার কোন জবাব দিল না।
পথের মধ্যে জল জমে আছে। সেই জল আশে পাশে দেওয়ালের গা বেয়ে চুয়ে চুয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে। জলের মধ্য দিয়ে হাঁটার দরুন জলের শাপ শপি শব্দ হতে লাগল।
আরো খানিকটা এগিয়ে মাঝি একটা সরু সুড়ঙ্গ পথের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, সামনেই গ্যাস ল্যাম্পের ত্ৰিয়মান আলোয় এক অপ্রশস্ত গুহাপথ যেন হাঁ করে মৃত্যু-ক্ষুধায় ওৎ পেতে আছে।
এই ১৩ নম্বর কাঁথি সাব। রতন মাঝি বললে।
হাতের গ্যাস ল্যাম্পটা আরো একটু উঁচু করে সুড়ঙ্গ পথের দিকে মাঝি পা বাড়াল, যাইয়ে সাব।
সুড়ঙ্গ পথে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া গেল না। প্রকাণ্ড একটা কয়লার চাংড়া ধ্বসে পড়ে পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। এবং সেই চাংড়ার তলা থেকে একটা সাঁওতাল যুবকের দেহের অৰ্দ্ধেকটা বের হয়ে আছে। বুক পিঠ এক হয়ে গেছে। কান ও মুখের ভিতর দিয়ে এক ঝলক রক্ত বের হয়ে এসে কালো কয়লা ঢালা পথের ওপরে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। পাশেই একটা লোহার গাইতি পড়ে আছে।