লম্বায় প্রায় ছয় হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হন হন করে যেন একটা ঝোড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
আমি নির্বাক হয়ে সেই অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।
এত কাছাকাছি, মনে হলো যেন আশপাশে কোথায় বাঘাট ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।
তুই হয়ত বলবি আমার শুনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।
তাছাড়া তুই তো জনিস সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ শির শির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম, বাসায় ফিরবার জন্য।
চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্ন ভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।
একবার, দুবার, তিনবার। সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল। তাড়াতাড়িতে নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝন ঝন শব্দে ততক্ষণে শংকরের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।
ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?
শংকরবাবু! আমি সুব্রত।
সুব্রতবাবু! হ্যাঁ, ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।
বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।
অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূর্ণাবর্ত তুলেছে।
বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ।
কিসের গোলমাল?
বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলি বস্তির দিক থেকে আসছে, সুব্রত বললে। চলুন। একবার; খবর নেওয়া যাক।
বেশ চলুন।
দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হলো।
গোলমালটা ক্ৰমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ পাতাল
জেগে উঠল। আবার অকস্মাৎ।
এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।
সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।
শংকর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে; যেন সহসা একটা তীব্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে ও একেবারে অসার পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারো মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে ভিতর থেকে এক ঝটিকায় ঘরের খিল খুলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টর্চটা ফেলে লাফিয়ে পড়ল।
আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটা ঘটতে বোধ হয়। কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।
সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শংকর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।
বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতের টর্চের তীব্ৰ বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল; কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।
ততক্ষণে শংকরও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে।
তবে?
বুঝতে পারছি না। সত্যি সত্যিই একি তবে ভৌতিক ব্যাপার?
বলতে বলতে শংকর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কোলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাট্ যুঁই ও বাবলা গাছ চোখে পড়ে। সেইদিকে শংকরের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল…কে? কে ওখানে, একটা কালো মূর্তি…তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।
চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়-অস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে : ওই দেখুন বাঘ। সরে যান। গুলি করি।
শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ ও সজোরে সুব্রতর কণ্ঠ ফুটে বের হয়ে এল।
স্যার আমি।…গুলি করবেন না। স্যার।…ইয়োর মোস্ট ফেইথফুল এণ্ড ওবিডিয়েণ্ট সারভেন্ট।
একটা চাপা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল।
কে?
আমি বিমল দে।…কোলিয়ারীর সরকার।
বিমলবাবু! শংকরের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এল।
দুজনে এগিয়ে গেল। শংকর বিমলবাবুর গায়ের ওপরে টর্চের আলো ফেলে প্ৰশ্নসূচক দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, এত রাত্রে এখানে এই শীতে মাঠের মধ্যে কী করছিলেন?
আগাগোড়া একটা সাদা ডোরা কাটা ভারী কালো কম্বলে মুড়ি দিয়ে বিমলবাবু সামনে দাঁড়িয়ে…
আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম স্যার।
আমার কাছে যাচ্ছিলেন? শংকর প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ। কুলি ধাওড়ায় একটা লোক খুন হয়েছে।
খুন হয়েছে!..সুব্রত চমকে উঠল।
হ্যাঁ বাবু, খুন হয়েছে।
গোলমালটা এখন বেশ সুস্পষ্টভাবে কানে এসে বাজছে।
চলুন, দেখে আসা যাক।
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শংকর বললে।
আগে শংকর, মাঝখানে বিমলবাবু ও সর্বশেষে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে কুলিবস্তির দিকে এগিয়ে চলল।
মাথার উপরে তারায় ভরা রহস্যময়ী অন্ধকার রাতের আকাশ কী যেন একটা ভৌতিক বিভীষিকার প্রতীক্ষ্ণয় উদ্গ্ৰীব।
আজ রাতে-কুয়াশার লেশমাত্র নেই।
০৫. আবার ভয়ঙ্কর চারটি ছিদ্র
সকলেই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু রাতের স্তব্ধ মৌনতার বুকে জেগে উঠেছে কতকগুলো ভয়ার্তা লোকের একটানা গোলমালের এলোমেলো একটা ক্ৰমবৰ্দ্ধমান শব্দের রেশ।