শংকর বলতে লাগল, তোমার কি মনে হয় সে সম্পর্কে?
চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় যেন কী একটা কিছু বেচারী প্ৰাণপণে এড়িয়ে যেতে চায়।
তুমি কিছু বলবে চন্দন?
সোৎসুকভাবে শংকর চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা যদি বলি অসন্তুষ্ট হবেন নাতো স্যার?
না, না-বল কি কথা।
আপনি চলে যান স্যার। এ চাকরী করবেন না।
কেন? হঠাৎ একথা বলছে কেন?
না স্যার, চলে যান আপনি; এখানে কারও ভাল হতে পারে না।
ব্যাপার কি চন্দন? এ বিষয়ে তুমি কি কিছু জান? টের পেয়েছে কিছু?
ভূত!..আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ভূত!…
হ্যাঁ। অত বড় দেহ কোন মানুষ হতে পারে না!
আমাকে সব কথা খুলে বল চন্দন সিং।
আপনার আগের ম্যানেজার সুশান্তবাবু মারা যাবার দিন দুই আগে বেড়াতে বেড়াতে পশ্চিমের মাঠের দিকে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিকে অস্পষ্ট আঁধার; হঠাৎ মনে হলো পাশ দিয়ে যেন ঝড়ের মত কী একটা সন সন করে হেঁটে চলে গেল। চেয়ে দেখি লম্বায় প্রায় হাত পাঁচ ছয় হবে। আগাগোড়া সর্বাঙ্গ একটা বাদামী রংয়ের আলখাল্লায় ঢাকা।
সেই অস্বাভাবিক লম্বা মূর্তিটা কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একটা পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেলাম। সে হাসি মানুষের হতে পারে না।
তারপর–।
তারপরের পর দিনই সুশান্তবাবুও মারা যান। শুধু আমিই নয়; সুশান্তবাবুও মরবার আগের দিন সেই ভয়ংকর মূর্তি নিজেও দেখেছিলেন।
কি রকম? রাত্রি প্রায় বারোটার সময়…সে রাত্রে কুয়াশার মাঝে পরিষ্কার না হলেও অল্প অল্প চাদের আলো ছিল–রাত্রে বাথরুমে যাবার জন্য উঠেছিলেন…হঠাৎ ঘরের পিছনে একটা খুক খুক কাশির শব্দ পেয়ে কৌতূহলবশে জানালা খুলতেই দেখলেন, সেই ভয়ংকর মুর্তি মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের মত হেঁটে যাচ্ছে।
সে মুর্তি আমি আজ স্বচক্ষে দেখলাম শংকরবাবু! দুজনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বক্তা সুব্ৰত! সে এর মধ্যে কখন এক সময় ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
০৪. আঁধারে বাঘের ডাক
কী দেখছেন?
ভূত। চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শংকরবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট?
চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।
এখানকার ঠিকাদার কে চন্দনবাবু?
ছট্টুলাল।
তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই! কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে।
দেবো, নিশ্চয়ই দেবো।
আচ্ছা চন্দনবাবু! আপনাকে কয়টা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?
সে কি কথা। নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?
আমি শংকরবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি জানো তো।
জানি–।
কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।
নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমিও ওঁকে বলেছিলাম। এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে।
আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে ও জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।
আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।
কি বলছেন সুব্রতবাবু।
হাঁ—ঠিকই বলছি—
কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরী কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব-তাই আমার ইচ্ছা সুব্রতবাবু; শংকর বললে।
বড় রকমের একটা বিপদ আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শংকরবাবু?…অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।
যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শংকর বললে।
যুক্তি হয়ত নেই। শংকরবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে?–সুব্রত বললে।
কিন্তু-চন্দন সিং বলে :
শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মুর্তি দেখেছি তাই নয়। স্যার। মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারে না। বঁচা অসম্ভব। গত তিনবার ম্যানেজার বাবুদের উপর দিয়ে গেছে.কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের উপর দিয়ে যাবে না।
সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হলো।
চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।
শংকর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে।
শংকরের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।
আজও সে শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল।
সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে বসে টেবিল ল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।
কিরীটী,
কাল তোকে এসে পৌছানর সংবাদ দিয়েছি; আজ এখানকার আশপাশ৷ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধু-ধু মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা যেন চারিদিকে প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।
বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইসারা; প্রকৃতির বুক ষ্টুয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোলফিল্ড বসেছে তারই মাইল খানেক দূরে বহু কাল আগে এক সময় একটা কোলফিল্ড ছিল। আকস্মিক ভাবে একরাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনো মাঝে মাঝে বড় বড় গর্ত মত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তর মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের হয়।
অভিশপ্ত খনির বুকে দুৰ্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্ৰকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি; অন্ধকাব চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছন পানে ফিরে তোকালাম। আশ্চর্য! কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না।