তারপর–
কোলিয়ারী স্টার্ট করা হয়েছে; অর্থাৎ তোমার কোলিয়ারীর গোড়া পত্তন আরম্ভ করা হয়েছে মাস দুই হলো।
থামছিস কেন, বল না- ৷
কিন্তু মাস দুইয়ের মধ্যে তিন-তিনটে ম্যানেজার খুন হয়েছেন।
তার মানে!
আরে সেই মানেই তো solve করতে হবে।
বুঝলাম, তা কী করে ম্যানেজার তিনজন মারা গেলেন?
ময়না-তদন্তে জানা গেছে তাদের গলা টিপে মারা হয়েছে, এবং গলার পিছন দিকে মারাত্মক রকমের চারটি করে ছিদ্র দেখতে পাওয়া গেছে। তা ছাড়া অন্য কোন দাগ বা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।
শরীরের অন্য কোন জায়গায়ও না?
না, তাও নেই!
আশ্চর্য!
তা আশ্চৰ্যই বটে। সত্যিই আশ্চর্য সেই চারটি কালো ছিদ্র। এবারকার নতুন ম্যানেজার হচ্ছেন আমারই কলেজ ফ্রেণ্ড শংকর সেন। সেও তোমার মতই গোয়ার গোবিন্দ ও একজন পাকা অ্যাথলেটু। সে সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে আমায় সেখানে যেতে লিখেছে।
দেখ কিরীটী, সুব্রত বললে, একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে।
যথা—
এবারকার রহস্যের কিনারার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দে। এতদিন তোমার সাকরেদি করলাম, দেখি পারি কিম্বা হারি।
বেশ তো! আমার সঙ্গেই চল না।
না। তা হবে না। পুরোপুরি আমার হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে তুই মাথা গলাতে পারবি না।
পুরাতন কলেজ ফ্রেণ্ড! যদি অসন্তুষ্ট হয়।
কেন? অসন্তুষ্ট হবেন কেন? আমি হালে পানি না পাই তবে না হয় তুই অবতীর্ণ হবি।
কিন্তু তখন যদি সময় আর না থাকে বিশেষ করে একজনের জীবন মরণ যেখানে নির্ভর করছে।
সব বুঝি কিরীটী। তার নিয়তি যদি ঐ কোলিয়ারীতেই থাকে। তবে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। তুই আমি তো কোন কথা; স্বয়ং ভগবানও পারবে না!
তা বটে। তা বেশ, তুই তা হলে কাল রওনা হয়ে যা। শংকরকে একটা চিঠি ড্রপ করে দেবো সমস্ত ব্যাপার খুলে লিখে।
হ্যাঁ! তাই দে! ভয় নেই কিরীটী! সুব্রত রায়কে তুই এটুকু বিশ্বাস করতে পারিস; বুদ্ধির খেলায় না পারি দেহের সবটুকু শক্তি দিয়েও তাকে প্ৰাণপণে আগলাবই।
দেহের শক্তিতে সেও কম যায় না সুব্রত। একটু গোলমাল ঠেকলেই কিন্তু তুই আমায় খবর দিস ভাই! অবিশ্যি চিঠি থেকে যতটুকু ধরতে পেরেছি তাতে ব্যাপারটা যে খুব জটিল তা মনে হয় না! এক কাজ করিস তুই বরং প্রত্যেকদিন কতদূর এগুলি বিশদভাবে আমায় চিঠি দিয়ে জানাস, কেমন।
বেশ, সেই কথাই রইল!
০৩. মানুষ না ভূত
কোলফিল্ডটা প্ৰায় উনিশ কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে। ধু-ধু প্ৰান্তর। তার মাঝে একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে কুলিবস্তী বসান হয়েছে। টেমপোরারী সব টালি ও টিনের সেড তুলে ছোট ছোট খুপরী তোলা হয়েছে। কোন কোনটার ভিতর থেকে আলোর কম্পিত শিখার মৃদু আভাস পাওয়া যায়। অল্প দূরে পাকা গাঁথনী ও উপরে টালির সে্ড দিয়ে ম্যানেজারের ঘর তোলা হয়েছে এবং প্রায় একই ধরণের আর দুটি কুঠী ঠিকাদার ও সরকারের জন্য করা হয়েছে। ম্যানেজারের কোয়ার্টার এতদিন তালা বন্ধই ছিল বিমলবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দেয়। কোয়ার্টারের মধ্যে সর্বসমেত তিনখানি ঘর, একখানি রান্নাঘর ও বাথরুম। মাঝখানে ছোট্ট একটি উঠান। দক্ষিণের দিকে বড় ঘরটায় একটা কুলি একটা ছাপর খাটের ওপরে শংকরের শয্যা খুলে বিছিয়ে দিল।
আচ্ছা, আপনি তা হলে হাতমুখ ধুয়ে নিন স্যার। ঠাকুরকে দিয়ে আপনার জন্য লুচি ভাজিয়ে রেখে দিয়েছি, পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে। বংশী এখানে রইল।
বিমলবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
শংকর শয্যায় ওপরে গা ঢেলে দিল।
রাত্ৰি প্ৰায় শেষ হয়ে এল।
কিন্তু কুয়াশার আবছায় কিছু বুঝবার জো নেই।
একটু বাদে বিমলবাবুর ঠাকুর লুচি ও গরম দুধ দিয়ে গেল। দুচারটে লুচি খেয়ে দুধ টুকু এক ঢেকে শেষ করে শংকর ভাল করে পালকের লেপটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন বিমলবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে শংকর দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের অরুণ রাগ তখন ঝিলিক হানছে।
সারাটা দিন কাজকর্ম দেখে শুনে নিতেই চলে গেল।
বিকালের দিকে সুব্রত এসে পৌঁছাল।
কিরীটি তার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল।
সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শংকর বেশ খুশীই হল।
তারও দিন দুই পরের কথা।
এ দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবশ্যকীয় কয়েকটা কাগজপত্ৰ শংকর টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বসে দেখছে।
সুব্রত বিকালের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরে নি! বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
শংকর উৎকৰ্ণ হয়ে উঠল, কে?
আমি স্যার। চন্দন সিং।
ভিতরে এসো চন্দন।
চন্দন সিং অল্প বয়সের পাঞ্জাবী যুবক।
এই কেলিয়ারীতে ম্যানেজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজে বহাল হয়েছে।
কি খবর চন্দন সিং?
আপনি আমায় ডেকেছিলেন?
কই না! কে বললে? কতকটা আশ্চর্য হয়েই শংকর প্রশ্ন করলে।
বিমলবাবু অর্থাৎ সরকার মশাই বললেন।
বিমলবাবু বললেন! তারপর সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে : ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে! বসো ঐ চেয়ারটায়। তোমার সঙ্গে গোটা কতক কথা আছে।
চন্দন সিং একটা মোড়া চেয়ে নিয়ে বসল।
এখানকার চাকরী তোমার কেমন লাগছে চন্দন?
পেটের ধান্দায় চাকরী করতে এসেছি। স্যার, আমাদের পেট ভরলেই হলো স্যার।
না, তা ঠিক বলছি না। এই যে পর পর দুজন ম্যানেজার এমনি ভাবে
সহসা চন্দন সিংয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়াতে শংকর চমকে উঠলো। চন্দনের সমগ্র মুখখানি ব্যেপে যেন একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিন্তু চন্দন সিং সেটা সামলে নিল।