ধীরে ধীরে হতভাগ্য সুধাময় চৌধুরীর প্রাণবায়ু বাতাসে মিশে গেল।
সহসা যেন নাটকের যবনিকাঁপাত ঘটল।
ঘরের সব কয়টি প্রাণীই স্তব্ধ।
কারও মুখে কোন কথা নেই।
কিরীটি এতক্ষণে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল, এবারে আমি আমার বক্তব্য সব সংক্ষেপে শেষ করব। কেন না, আজকের রাত্রের bus-ই আমার ধরতে হবে। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের কাছে খুলে না বললে আমার এই ব্যাপারে। explanationটা সহজবোধ্য হবে না। বর্তমানে এই যে এখানকার কোলিয়ারীটা দেখছেন, ৫০ বছর আগে এই কোলিয়ারীর পাশের ঐ একটা কোলিয়ারী হঠাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ ধ্বসে যায়। এরূপ কিংবদন্তী আছে। তারপর থেকেই এখানকার আশেপাশের লোকেরা এ জায়গাটা সম্পর্কে নানা প্রকার মনগড়া বিভীষিকার কথা তুলে এটাকে অভিশপ্ত করে তোলে। এমনি করে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর কেটে যায়।
কেউ এর পাশে ঘেঁষে না।
এমন সময় কোলিয়ারী শুরু করবার ইচ্ছায় মিঃ ঝুন-ঝুন-ওয়ালা ও সুধাময় চৌধুরী এদিকে ঘুরতে ঘুরতে এই অভিশপ্ত ফিল্ডটার সন্ধান পান এবং অচিরে এটার লিজ নেন নব্বই বছরের জন্য খুব সামান্য টাকায়।
কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে আরও বছর চারেক কেটে যায়।
তারপর কাজ শুরু হলো।
কাজ বেশ এগুচ্ছে এবং ফিল্ড থেকে প্রচুর কয়লা উঠছে। এই সময় শয়তান সুধাময়ের মনে কু-মতলব জাগল। তিনি মনে মনে বদ্ধপরিকর হলেন ঝুন-ঝুন-ওয়ালাকে ফাকি দিতে। কিন্তু কেমন করে ঝুন-কুনি-ওয়ালাকে সরান যায়। সেই চিন্তা করতে লাগলেন।
একদিন খনির কাজ পরিদর্শন করতে এসে সামান্য অজুহাতে খনির সরকার বিকাশবাবু ও ম্যানেজারের এ্যাসিসটেন্ট সত্যকিংকরবাবুকে বরখাস্ত করে নিজের লোক বিমলবাবু ও চন্দনসিংহকে নিযুক্ত করে গেলেন। চন্দনসিং ও বিমলবাবু ছিল সুধাময়বাবুর ডান ও বাঁ হাতের অপকর্মের প্রধান সঙ্গী ও সহায়ক। বিমলবাবু ও চন্দনসিং সুধাময়বাবুকে সকল সংবাদ সরবরাহ করত ও খনিটা ভৌতিক এই কিংবদন্তীকে আরো সুদৃঢ় করবার জন্য প্রোপাগাণ্ডা চালাত দিবারাত্র নানাভাবে।
সুধাময়বাবুর রং ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নিজে বহুকাল সাঁওতাল পরগণায় ঘুরে ঘুরে সাঁওতালদের সামাজিক রীতিনীতি আচারব্যবহার ও কথাবার্তাও পুরোপুরিভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন, এবং যাতে করে তিনি অনায়াসেই, সাঁওতাল কুলীদের মধ্যে তাদেরই একজন সেজে দিব্যি খোশ মেজাজে একের পর এক খুন করে চলেছিলেন। অথচ কেউ কোনদিন সন্দেহ করবার অবকাশ পায় নি।
সুব্রতকে পাঠিয়ে দিয়েই আমি গোপনে পরের দিন সকালেই পাগলের ছদ্মবেশে এখানে চলে আসি এবং চারদিকে নজর রেখে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করি।
আমার কেন যেন মনে হয়, যে খুন করেছে এইভাবে পরপর ম্যানেজারদের, সে এখানেই সর্বদা উপস্থিত থাকে। কিন্তু কীভাবে সে এখানে থাকতে পারে? কৰ্মচারীদের মধ্যে একজন হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়; কেন না তাতে চাটু করে ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে কেমন করে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। অথচ এ কথা যখন অবধারিত এখানে সর্বদা উপস্থিত না থাকলে চারিদিকে দেখে শুনে তার পক্ষে খুন করা সম্ভব হয় না, তখন নিশ্চয়ই কুলীদের মধ্যেই তাদের একজন হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।
সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে দিই।
এবং এখানে আসবার দিন রাত্রে যখন কুলীদের মধ্যে একজন খুন হলো, সে সময় আমি কুলীদের ধাওড়ার মধ্যেই কুলী সেজে উপস্থিত ছিলাম; কুলীটাকে খুন করে সুধাময় কুলীর ছদ্মবেশে যখন পালায় তখন আমি অন্ধকারে অনুসরণ করে তার ঘরটা দেখে আসি।
বিমলবাবু ও চন্দনসিং-এর সাহায্যে নয়জন কুলীকে রাতারাতি ধানবাদ কাজের অছিলায় হাঁটা পথে রেল লাইন ধরে প্রচুর টাকা ঘুস দিয়ে বিদায় করে। মাত্র একজন কুলি নিয়ে বিমলবাবুর সাহায্যে রামলোচনের জামার পকেট থেকে চাবি চুরি করে, খনির মধ্যে নেমে ডিনামাইট্র দিয়ে পিলার ধ্বসিয়ে ১৩নং কাঁথি ভাঙ্গা হয় তাও আমার নজর এড়ায় না। সুব্রত তুমি রুমালে বাঁধা পলতে ও ডিনামাইট্ পেয়েছ।
পরের দিন সকলে জানাল ১০জন লোক মারা গেছে। যদিও মারা গেল একজন মাত্র। এটা শুধু কুলীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করবার জন্য সাজিয়ে করা হয়েছিল।
ম্যানেজারদের মারা হয়। চারিদিকে সকলের মনে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক জাগাবার জন্য যাতে করে খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং খনির কাজ বন্ধ হয়ে গেলে নিজে শেয়ার ছেড়ে দেবার ভাণ। দেখিয়ে ঝুন-ঝুন-ওয়ালাকে দিয়ে তার শেয়ারও বিক্রয় করিয়ে বেনামীতে সমগ্র খনিটা কিনে নিলেই কাজ হাসিল হয়ে যায়।
সব কিছু প্ৰায় হয়ে এল, সুধাময় কুন-ঝুন-ওয়ালার সঙ্গে চিঠিপত্র লিখে যখন সব ঠিক করে ফেললে তখন তার অপকর্মের সহায়ক বিমলবাবু ও চন্দনসিংহকে সরাবার মতলব করল।
গতকাল বিমলকে মারলেও চন্দন সিং নাগালের বাইরে পালিয়ে গেল। কেন না প্রভুর মনোগত ইচ্ছােটা সে আগেই টের পেয়েছিল। Metalic mails, পরে তাতে বিষ মাখিয়ে হাতের আঙ্গুলে পরে, তার সাহায্যে গলা টিপে সুধাময় কাজ হাসিল করত। Strangle করবার সময় সেই Metalic mails গলার মাংসে বসে গিয়ে বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটাত। এখন কথা হচ্ছে শার্দুলের ডাক যেটা শোনা যেত সেটা আর কিছুই নয়; সুধাময় নিজেই মুখ দিয়ে বাঘের হুবহু অনুকরণ করতে পারত। তোমরা হয়ত শুনে থাকবে এক একজন অবিকল পশু পক্ষীর ডাক মুখ দিয়ে অনুকরণ করতে পারে। এটা একটা মানুষকে ভয় দেখাবার ফন্দি। তা ছাড়া খুব উঁচু হিলওয়ালা এক প্রকার কাঠের জুতো পরে গায়ে একটা ধূসরবর্ণের ওড়না চাপিয়ে সুধাময় মাঠের মধ্যে দিয়ে দ্রুতবেগে চলত। একে সে একটু বেশী রকম লম্বা ছিল, তার উপরে ওই কাঠের জুতো পরাতে তাকে বেশ অস্বাভাবিক রকম বলে মনে হতো। কাঠের জুতো ব্যবহার করবার মধ্যে আরো একটা মতলব তার ছিল; পায়ের ছাপ পড়ত না। সুব্রতকে মারবার জন্য একটা সাঁওতাল কুলীকে সুধাময়বাবুই, engage করেছিলেন; কুলীটা বিষাক্ত তাঁর চূড়লো কিন্তু unsuccessfull হলো; কিন্তু সুব্রতকে তাঁর ছোঁড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সুধাময়ও লোকটাকে গুলী করে মারে; আমিই সেই সময় ওদের পিছনে follow করতে করতে উপস্থিত ছিলাম বলে সব ব্যাপারই নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। এই হল এখানকার খনির মৃত্যু রহস্য। কিরীটী চুপ করল।