নাম কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়! কোন কিরীটী রায়? বৰ্মার বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্ৰমর প্রভৃতির যিনি রহস্য ভেদ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের নাম হয়েছে বটে। কবে আসবেন তিনি?
আজই তো আসবার কথা ছিল, কিন্তু এলো না তো দেখছি। কাল হয়ত আসবে।
এমন সময় বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
বাস এসে গেছে।
বাস মানে একটা কমপার্টমেণ্ট এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়।
চা পান শেষ করে দাম চুকিয়ে নিয়ে দুজনে বাসে এসে উঠে বসল।
অল্পক্ষণ বাদেই বাস ছেড়ে দিল।
শীতের অন্ধকার রাত্রি কুয়াশার আবরণের নীচে যেন কুঁকড়ে জমাট বেঁধে আছে।
খোলা জানালা পথে শীতের হিমা শীতল হওয়া হু-হু করে এসে. যেন সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়ে যায়। এতগুলো গরম জামাতেও যেন মানতে চায় না। দুজনে পাশাপাশি বসে চুপ চাপ।
কাতরাসগাড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি হচ্ছে ওদের গন্তব্য স্থান।
কাতরাসগড় স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বেশ খানিকটা পথ।
রাত্রি প্রায় তিনটের সময় গাড়ী এসে কাতরাসগড় স্টেশনে থামল।
অদূরে স্টেশন ঘর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে।
একটা সাঁওতাল কুলী এদের অপেক্ষায় বসেছিল।
তার মাথায় স্যুটকেশ ও বিছানাটা চাপিয়ে একটা বেবী পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে ওরা রওনা হয়ে পড়ল।
নিঝুম নিস্তব্ধ কনকনে শীতের রাত্রি।
আগে বিমলবাবু এগিয়ে চলেছে, হাতে তাঁর আলো, চলার তালে দুলছে।
আলোর একঘেয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধ প্ৰান্তরে মৌনতা ভঙ্গ করছে। মাঝে মাঝে এক একটা দমকা হাওয়া হু-হু করে বয়ে যায়।
মাঝখানে শংকর। সবার পিছনে মোটঘাট মাথায় নিয়ে সাঁওতালটা।
একপ্রকার বেঁকের মাথায়ই শংকর এই কাজে এগিয়ে এসেছে। চিরদিন বেপরোয় জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এ দুনিয়ায় ভয় ডর বলে কোন কিছু কোন প্রকার বিপদ আপদ তাকে পিছনটান ধরে রাখতে পারে নি। সংসারে একমাত্র বুড়ী পিসিমা। আপনার বলতে আর কেউ নেই। কে-ই বা বাধা দেবে?
বিমলবাবুর মুখ থেকেই শোনে কোলিয়ারীর ইতিহাসটা শংকর। বছর দুই আগে কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে পুর্ববঙ্গের এক ধনী-পুত্র কোলিয়ারী করবার ইচ্ছায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই ম্যানেজার রামহরিবাবু একান্ত আশ্চর্যভাবে তার কোয়ার্টারে এক রাত্রে নিহত হন। দ্বিতীয় ম্যানেজার বিনয়বাবু কিছুদিন বাদে কাজে বহাল হন। দিন পনের যেতে না যেতে তিনিও নিহত হন। তারপর এলেন সুশান্তবাবু, তাঁরও ঐ একইভাবে মৃত্যু ঘটলো। পুলিশ ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্টাতেও কে বা কারা যে এদের এমন করে খুন করে গেল তার সন্ধান করতে পারলে না। তিন তিন বারই একটি কুলি বা কর্মচারী নিহত হয়নি, তিনবারই ম্যানেজার নিহত হল। মৃত্যুও ভয়ঙ্কর। কে যেন ভীষণভাবে গলা টিপে হতভাগ্য ম্যানেজারের মৃত্যু ঘটিয়েছে, গলার দুপাশে দুটি মোটা দাগ এবং গলার পিছন দিকে চারটি কিলো কালো গোল ছিদ্র।
শংকর যেখানে কাজ করছিল। সেখানকার বড়বাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একান্ত কৌতূহল বশেই নিজে এ্যাপ্লিকেশন করে কাজটা সে নিয়েছে চার মাসের ছুটি মঞ্জর করিয়ে।
এখানে রওনা হবার আগের দিন কিরীটিকে একটা চিঠিতে আগাগোড়া সকল ব্যাপার জানিয়ে, আসবার জন্য লিখে দিয়ে এসেছে।
কিন্তু এই নিশুতি রাতে নির্জন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়, কে জানে এমনি করে নিশ্চিত মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাল করল কি মন্দ করল।
অদূরে একটা কুকুর নৈশ স্তব্ধতাকে সজাগ করে ডেকে উঠল।
ওরা এগিয়ে চলে।
০২. ভয়ংকর চারটি কালো ছিদ্র
শংকর সেন কিরীটীর কলেজের বন্ধু, একই কলেজ থেকে ওরা বি, এস-সি পাশ করেছিল।
রসায়নে এম, এস-সি পাশ করে শংকর মামার বন্ধুর কোলিয়ারীতে কাজ নিয়ে চলে যায়। সেও দীর্ঘ পাঁচ বছরের কথা। কিরিটী তার আগেই রহস্যভেদের জালে পাক খেতে খেতে এগিয়ে গেছে অনেকটা। বছর দুই আগে কলকাতায় দুজনের একবার ইষ্টারের ছুটিতে দেখা হয়েছিল।
তারপর কেউ কারো সংবাদ পায় নি। হঠাৎ শংকরের চিঠি পেয়ে কিরীটি বেশ খুশীই হলো।
জংলীকে ডেকে সব গোছগাছ করতে বলে দিল। পরের দিন তুফান মেলে যাবে সব ঠিক, এমন সময় সুব্রত এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।
একতলার ঘরে জংলীকে সব গোছগাছ করতে দেখে প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কী জংলী?
বাবু কাঁত্রাসগড় চলেছেন। হঠাৎ? কী জানি বাবু! আপনাদের কয় বন্ধুর কি মাথার ঠিক আছে? বৰ্মা, লঙ্কা, হিল্পী, দিল্লীতে আপনারা লাফালাফি করতেই আছেন।
সুব্রত হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ােল। কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে। চুরুট টানছিল। সুব্রতর পায়ের শব্দে মুদ্রিত চোখেই বললে।
কিবা প্রয়োজনে
এ অকিঞ্চনে
করিলে স্মরণ?
সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল :-
আসি নাই সন্ধি হেতু,
ফাটাফাটি রক্তারক্তি
খুনো খুনী,
যাহা হয় কিছু!
পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি;
জংলীরে সাথে লয়ে
কোথায় চলেছো;
দিয়ে অভাগা আমারে ফাঁকি?
কিরীটী বললে,
করিয়াছি মন
সুদূর কাতরাসগড়
বারেক আসিব ঘুরি।
নে নে, থামা বাবা তোর কবিতা। সত্যি, হঠাৎ কাতরাসগড় চলেছিস কেন?
কিরীটি সোফার ওপরে সোজা হয়ে বসে, হাতের প্রায় নিভন্ত সিগারটা অ্যাসট্রেতে ফেলে বললে।
হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড।
অর্থাৎ!
শোন। কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি একটা কোল্ডফিল্ড আছে! সেটার মালিক পূর্ববঙ্গের কোন এক যুবক জমিদার নন্দন।