সকলে এক সঙ্গে হেসে উঠল, কিরীটীর নিজস্ব কবিতা শুনে।
কিন্তু আমার শরীর যে ঘুমে ভেঙে আসছে শংকর, শীঘ্ৰ কোথায় শুতে দিবি বল। কিরীটী শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
শংকর নিজের ঘরেই এক পাশে একটা ক্যাম্প খাটে কিরীটীর শোয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।
কিরিটী শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে নিল।
পরের দিন সকলে শংকর ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
এমন সময় একজন সাঁওতাল কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির বাবু হুজুর মালিক এসেছেন গো।– মালিক, কখন এলেন তিনি?
কাল রাতে বাবু।
কে কাল রাতে এসেছেন শংকর?
চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে কিরীটী?
খনির মালিক সুধাময়বাবু কাল রাত্রে এসেছেন।
যা তাড়াতাড়ি মনিবের সঙ্গে একবার মোলাকাত করে আয়।–
হ্যাঁ যাই।–
হাত মুখ ধুয়ে শংকর তখুনি মনিবের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল।
খনির অল্প দূরে মাঠের মধ্যে একটা বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ি।
খনির দুজন অংশীদার হনুমানপ্ৰসাদ কুন-ঝুন-ওয়ালা আর সুধাময় চৌধুরী? অংশীদারের মধ্যে কেউ কখন এলে ঐ বাংলো বাড়িতেই ওঠেন। অন্য সময় বাংলো তালা চাবি দেওয়াই থাকে।
শংকর যখন এসে বাংলো বাড়িতে প্ৰবেশ করল, সুধাময় বাবু তখন ঘুম ভেঙে উঠে বসে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচির সদব্যবহার করছেন।
ভৃত্যকে গিয়ে সংবাদ পাঠাতেই শংকরের ভিতরে ডাক এল। বহুমূল্য আসবাব পত্রে সাজান কক্ষখানি; গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
একটা বেতের চেয়ারে বসে সুধাময়বাবু প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন।
শংকর ঘরে ঢুকে হাতে তুলে নমস্কার জানাল, নমস্কার … স্যার।
নমস্কার। বসুন। আপনিই এখানকার নতুন ম্যানেজার শংকর সেন?
অজ্ঞে।
বেশ। বেশ।
শংকর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
ওরে কে আছিস, ম্যানেজারবাবুকে চা দিয়ে যা।
সুধাময়বাবু হাঁক দিলেন।
না না। ব্যস্ত হবেন না। এইমাত্র বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরিয়েছি।
তাতে আর কী? add a cup more, কোন harm নেই।
শংকর সুধাময়বাবুর দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।
উঁচু, লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। মাথার মাঝখানে সিঁথি। চোখা নাক। চোখ দুটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ লালচে। শিকারী বিড়ালের মত সদা চঞ্চল, অস্থির ও সজাগ। গায়ের রং আবলুশ কাঠের মত কালো। ভদ্র বেশ না হলে সাঁওতালদেরই একজন ধরা যেতে পারে অনায়াসেই। গায়ে বাদামী রংয়ের দামী সার্জের গরম স্যুট।
ভৃত্য চা দিয়ে গেল। শংকর চায়ের কাপটা টেনে নিল।
তারপর মিঃ সেন, আপনাদের কাজকর্ম চলছে কেমন?
মন্দ না। তবে পরপর এমনভাবে খুন হওয়ায় এখানকার কুলী কামিনদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কাল রাত্রে আমাদের সরকারমশাই বিমলবাবু অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।
কে নিহত হয়েছে?
বিমলবাবু?
The villain. Rightly served. I hated him most amongst my employees; but I am also determined to give up my shares. I am really fed-up with all this. ঝুন-ঝুনওয়ালাও আজই বিকালের দিকে এসে পৌঁছাচ্ছেন শুনলাম। তিনিও বেচে দেবেন। তাঁর share.
মনিবকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম দেখে, শংকরের বাংলোয় ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো বেজে গেল।
সন্ধ্যার ধূসর ছায়া ধরিত্রীর বুকে যেন রহস্যের যবনিকার মত নেমে এসেছে।
শংকরের ডাক-বাংলোয়, সকলে একত্রিত হয়েছে। খনির দুই অংশীদার, সুধাময় চৌধুরী ও হনুমান প্ৰসাদ ঝুন-ঝুন-ওয়ালা, সুব্রত, কিরীটী, দারোগাবাবু ছদ্মবেশে ও শংকর নিজে। কিরিটী বলছে আজ অপরাধী কে সকলের সামনে প্ৰকাশ করে বলবে এবং হাতে হাতে দারোগাবাবুর জিম্মায় দিয়ে দেবে। সুধাময়বাবু ও ঝুন-ঝুন-ওয়ালা দুজনেই বলেছেন। অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারলে দুজনেই পাঁচ-হাজার করে দশ হাজার টাকা কিরীটীকে পুরস্কার দেবেন।
কিরীটী বলতে লাগল– Before I mention the name let me have my reward first of all with the promise that if I fail will return the same
সুধাময়বাবু ও কুন-বুন-ওয়ালা দুজনেই হাসতে হাসতে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকার দু:খানা চেক লিখে দিলেন, এই নিন।
তা হলে আপনারা সকলে শুনুন।
এই খনি অভিশপ্তও নয়, ভূতের আস্তানাও নয়; প্রচুর লাভের খনি। …এবং আজ পর্যন্ত এই খনিতে যতগুলো খুন হয়েছে তার জন্য সর্বাংশে দায়ী খনির অন্যতম অংশীদার স্বয়ং সুধাময় চৌধুরী।…
ঘরের মধ্যে বজ্ৰপাত হলেও বোধ হয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।
প্রবল ব্যঙ্গ মিশ্রিত স্বরে সুধাময়বাবু প্ৰচণ্ড হাসির তুফান তুলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার এক হাত প্যান্টের পকেটে —সহসা পিস্তলের গর্জন শোনা গেল।
গুড়ুম।
উঃ! একটা বেদনার্ত চিৎকার করে সুধাময়বাবু একপাশে টলে পড়লেন, এক হাত দিয়ে ডানদিকে পাজরা চেপে ধরে অন্যহাত থেকে একটা রিভলভার ছিট্কে পড়ল।
শয়তান। কুকুর। তোকে কুকুরের মতই গুলী করতে বাধ্য হলাম, দারোগাসাহেব গর্জন করে উঠল—না হলে তুই-ই হয়ত এখনি আমায় গুলী করতিস। জীবনে আজ এই প্ৰথম সত্যিকারের গুলী করতে বাধ্য হলাম, কিন্তু তার জন্য আমার এতটুকুও অনুশোচনা হচ্ছে না। যে নৃশংস এতগুলো খুন পর পর করতে পারে—তার একমাত্র শাস্তিই পাগলা কুকুরের মত গুলী করে মারা।–
উঃ। কিরীটীবাবু। আপনার কথাই ঠিক। অতি লোভ সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমার মৃত্যুর কারণ হলো।—হ্যাঁ স্বীকার করছি আমি-আমিই সব খুন করেছি। —উঃ –