না। তবে যদি বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি হেড়ু কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?
হ্যাঁ, পেলে ভাল হতো। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?
বলুন।
একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেই কাগজে মোড়ান। গত রাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
ব্যাপার কী? ওটা কী আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।
কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোন মারাত্মক রকমের বিষ মাখান আছে; দয়া করে এটা ধানবাদের কোন কেমিস্টের কাছ থেকে একটু একজামিন করে কি বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?
চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হবো বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন? এক হস্তার মধ্যেই Chemical Examination এর report পেয়ে যাবেন।
দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।
তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
শংকর খাদের দিকে রওনা হল। সুব্রত চেয়ারটার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।
১৪. রাত্রি যখন গভীর হয়
প্রতি রাতের মত আজও রাত্রির অন্ধকার ধূসর কুয়াশার ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে শ্রান্ত ক্লান্ত ধরণীর বুকে নেমে এল। পাখীর দল কুলায় গেল ফিরে। সারাদিন খনিতে খেটে ক্লান্ত সাঁওতাল কুলী কামিনরা যে যার ধাওড়ায় ফিরে এসেছে। সুব্রত চুপটি করে বারান্দায় একটা বেতের ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দুরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
কাল হয়ত কিরীটীর চিঠি পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের রাতটা?
একি নির্বিঘ্নে কাটবে?…
রাতের অন্ধকারে কী আজ তার বিভীষিকাময় মৃত্যুর কঠিন হিম পরশ কোন হতভাগ্যের ওপরে নেমে আসবে না?
দূর থেকে সাঁওতালী বাঁশী ও মাদলের সুর ভেসে আসে।
জীবনের কোন মূল্যই ওদের কাছে নেই। প্রকৃতির মেহের দুলাল ওরা মাটির ঘরে অযত্নে বর্ধিত, মাটি-মাখা সহজ ও সরল শিশুর দল। প্ৰাণ প্রাচুর্যে জীবনের পাত্র ওদের কানায় কানায় পূর্ণ।
শংকর এখনও খাদ থেকে ফেরে নি।
ঝুমন গরম চা, কেক ও ফল প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গেল।
সুব্রত একটুকরো কেক মুখে পুরে চায়ের কাপটা তুলে নিল। বাইরে আজ ঠাণ্ডাটা যেন একটু চেপেই এসেছে!
মাঝে মাঝে খোলা প্ৰান্তর থেকে আসন্ন রাতের স্তব্ধতা যেন বহন করে। আনে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা।
এক সময় চায়ের পাত্র নিঃশেষ করে সুব্রত পাশের টিপিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে দিল।
কত রকম চিন্তাই একটার পর একটা মাথার মধ্যে এল মাকড়সার জলের মত।
এবং সেই জালের সূক্ষ্ম তন্তুগুলি বেয়ে বেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারিটি দাগের মত কী যেন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
কী ওগুলো?
ভূতের মত একাকী চুপ করে এই বারান্দায় ঠাণ্ডায় বসে বসে কী ভাবছেন?
চোখ তুলে তাকায় সুব্রত।
কে? শংকরবাবু? সুব্রত ধীরকণ্ঠে বলে।
কী এত ভাবছিলেন বলুন তো? এখানে এসে আপনার এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তবুও টের পাননি?
হাসতে হাসতে শংকর জিজ্ঞাসা করে।
এ বেলা কাজের অবস্থা কেমন? Peacefully work চলছে তো?
কতকটা, যদি কিছু দুর্ঘটনা আচমকা না এসে পড়ে।
হঠাৎ এ কথা কেন শংকরবাবু?
বলা তো যায়না। শংকর মৃদুকণ্ঠে বলে, বিমলবাবুর ভাষায় বলতে গেলে এই ভৌতিক ফিল্ড-এ যখন তখনই যে কোন ভয়ঙ্কর ব্যাপারই তো ঘটা সম্ভব সুব্রতবাবু। তা ছাড়া নূতন ম্যানেজারবাবু এখনও ভূতের হাতে আক্রান্ত হন নি যখন।
সুব্রত কোন কথা বলে না।
তারপর আপনার কাজ কতদূর এগুলো সুব্রতবাবু?
How far you have proceeded?
অনেকটা।
বলেন কী? শংকরের কণ্ঠস্বর উদ্গ্ৰীব হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ। -কিন্তু এখনও আমাদের দারোগাবাবু এসে পৌঁছালেন না।
দারোগাবাবুর এখন আসবার কথা আছে নাকি? শংকর উৎকণ্ঠিতভাবে প্রশ্ন করে।
তাঁকে সন্ধ্যার পরই যে বাসটা থামে, তাতে দুজন কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলাম।
কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলেছিলেন? কেন? হঠাৎ কনেস্টবল নিয়ে আসবেন কেন? কাউকে গ্রেপ্তার করবেন নাকি?
শংকর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু চারিদিককার অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। আবার শংকর প্রশ্ন করে। আমি যে অন্ধকারেই থাকছি। সুব্রতবাবু! Please খুলে বলুন। কাকে গ্রেপ্তার করবেন?–
খুনীকে। –রহস্যের হোতাকে।
পেরেছেন বুঝতে তাহলে সত্যিই? পেরেছেন জানতে হত্যাকারী কে?
একরাশ উৎকণ্ঠ শংকরের গলার স্বরে ফুটে বেরুল।
হ্যাঁ-সুব্রত জবাব দেয়। আপনিই বলুন কে? সুব্রত স্মিতভাবে শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আগে বলুন, এই খনির Areaর মধ্যে সেই লোকটি আছে কিনা? তারপর বলছি।
শংকর সুব্রতর মুখের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
যদি বলি আছে? সুব্রত মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
তা হলে বলব আমি একজনকে সন্দেহ করেছি, সুব্রতবাবু।
কে? বিমলবাবু-এই খনির সরকার?
হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, how could you guess! আপনারা দেখছি সর্বজ্ঞ–am I right সুব্রতবাবু? অধীরভাবে শংকর সুব্রতকে প্রশ্ন করে।
You are right শংকরবাবু। ধীরভাবে সুব্রত জবাব দেয়।
আজ তাহলে বিমলবাবুকেই গ্রেপ্তার করছেন বলুন। শংকরবাবু আবার জিজ্ঞাসা করেন।
এমন সময় দারোগাবাবু দুইজন কনেস্টবল সমভিব্যাহারে এসে হাজির হলেন। বাংলোর বারান্দায় উঠতে উঠতে দারোগাবাবু বললেন, আমরা এসে গেছি সুব্রতবাবু।