বুকের ভিতরকার হৃদপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল।
পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টাৰ্চটা টেনে বের করল।
যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোতাম টিপে দিল।
অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে।
কিন্তু ও কে?…অন্ধকারে পলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁজছে।
আশ্চর্য। এই অন্ধকারে পলাশ বনের মধ্যে আমন করে লোকটা কী খুঁজছে?
সুব্ৰত এগিয়ে গেল। লোকটা বোধ করি পাগল হবে।
এক মাথা বঁকড়া বঁকড়া এলোমেলো বিস্রস্ত জট পাকান চুল। মুখ, ধূলো বালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্ৰী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকেট, শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা ন্যাকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন প্যান্ট।
সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।
এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।
কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না। সুব্রতর কথায় শুকনো ঝরে পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়।
এই তুই কে?
সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।
লোকটা কেবল হাসে।
হাসি যেন আর থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে।
সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল।
সহসা লোকটা ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু!
সুব্ৰত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।
তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?
আমার নাম রাজা বটে …থাকি উই-যেথা মারাংবরু রইছে।
এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস?
তাতে তুর দরকারডা কী? যা ভাগ।
সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না। সুব্ৰত সেখান থেকে চলে এল।
পলাশ বন ছাড়ালেই ৬ নং কুলীর ধাওড়া।
রতন মাঝি সেখানেই থাকে।
পলাশ ও শালবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলিধাওড়ার সামনে প্ৰজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস।
মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে, ধিতাং! ধিতাং!
সঙ্গে সঙ্গে বাঁশীতে সাঁওতালী সুর।
সারাদিন খাদে ছুটি গেছে, সব আনন্দ উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে।
ধাওড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা কালো কুকুর ঘেউ-উ-উ করে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সাঁওতাল যুবক এগিয়ে এল, কে বটে। রে? আঁধারে ঠাওর করতে লারছি। রা করিস না কেনে?
রতন মাঝি আছে? সুব্রত কথা বলে।
আরে বাবু। ও পিনটু, বাবুকে বসবার জায়গা দে। বসেন আইজ্ঞ। রতন মাঝি সুব্রতর সামনে এগিয়ে আসে।
আধো আলো আধো আঁধারে মাঝির পেশল কলো দেহটা একটা যেন প্রেতের মতই মনে হয়।
কিছু সংবাদ আছে মাঝি?
না বাবু। সারাটি দিনমানই রইলাম বটে।
সুব্রত আরো কিছুক্ষণ রতন মাঝির সঙ্গে দুচারটা আবশ্যকীয় কথা বলে ফিরল।
১০. অদৃশ্য আততায়ী
সেই আগেকার পথ ধরেই সুব্রত আবার ফিরে চলেছে। আকাশে কাস্তের মত সরু এক ফালি চাদ জেগেছে, তারই ক্ষীণ জ্যোৎস্না শীতার্ত ধরণীর ওপরে যেন স্বপ্নের মতই একটা আলোক ওড়না বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ ও মহুয়া বনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো চাঁদের আলোর আলপনা। বনপথে যেন আলোর আলপনা ঢাকাই বুটি বুনে দিয়েছে। মাদল ও বাঁশীর শব্দ তখনও শোনা যায়।
সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে পথ চলছিল, সহসা সোঁ করে কানের পাশে একটা তীব্র শব্দ জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্তব্ধ আলোছায়া ঘেরা বনতল প্ৰকম্পিত করে বন্দুকের আওয়াজ জেগে উঠলঃ গুড়ুম।…এবং সঙ্গে সঙ্গে করে যেন আর্ত চীৎকার কানে এল। সুব্রত থমকে হতচকিত হয়ে থেমে গেল।
প্রথমটায় সে এতখানি বিচলিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ব্যাপারটা যেন ভাল করে কোন কিছু বুঝে উঠতেই পারে নি। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে, কোমরবন্ধে লোডেড রিভলভারটা ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে যে দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। কিছু দেখা যায় না বটে। তবে শুকনো পাতার ওপরে একটা ঝটপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সুব্রত রিভলভারটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে টর্চটা জ্বালল এবং টর্চের আলো ফেলে সন্তপণে এগিয়ে গেল, শব্দটা যে দিক থেকে আসছিল। সেই দিকে।
অল্প খুঁজতেই সুব্রত দেখলে একটা পলাশ গাছের তলায় কে একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছট্ফট্ করছে।
সুব্রত লোকটার গায়ে আলো ফেললে।
লোকটা একজন সাঁওতাল যুবক।
লোকটার ডানদিকের পাঁজরে গুলি লেগেছে।
তাজা লাল টকটকে রক্তে বনতলের মাটির অনেকটা সিক্ত হয়ে উঠেছে।
লোকটার পাশেই একটা সঁওতালী ধনুক ও কতকগুলো তাঁর পড়ে আছে।
সুব্রত লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু সাঁওতালটাকে চিনতে পারল না।
লোকটা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে প্ৰায় শেষ হয়ে এসেছে। দুএকবার ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড় বিড় করে বলতে বলতে হতভাগ্য শেষ নিশ্বাস নিল।
সুব্রত নেড়ে চেড়ে দেখলে, শেষ হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস সুব্রতর বুকখানাকে কাঁপয়ে বের হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে আশে পাশের বন ও ঝোঁপ ঝাড় দেখলে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
হতভাগা সাঁওতালটা বন্দুকের গুলি খেয়ে মরেছে এবং স্বকৰ্ণে সে বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনতে পেয়েছে।