…সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমেলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক…আসতেই হবে! সে আসবে! আসবে!
অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে!
সুব্ৰত চেয়ার ছেড়ে ওঠে, ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে।
বাইরে গোলমাল শোনা গেল।
পুলিশের লোক এসে গেছে অদূরবর্তি কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।
চঞ্চলপদে পুঁটলিটা আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দী নিয়ে, ধাওড়ার লাস ময়না তদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাসগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শংকরবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।
সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল : এখানে ইতিপূর্বে যে সব ম্যানেজারবাবু খুন হয়েছেন তঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান। তবে তার বড্ড উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, একথা বলতে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কত যে খুশী হলাম। কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।
সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিশের লোক হয়েও যে আপনি এত উদার, সত্যই আশ্চর্যের বিষয়। কিরিটী যদি এখানে আসে। তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাবো। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা! নমস্কার।
০৯. আঁধার রাতের পাগল
সুব্রত শংকরবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।
বিকালের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেনঃ কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কর্তার হুকুম আছে কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।
রাতে শংকর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু। কাল থেকে তা হলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?
হ্যাঁ দিন। দুচার দিনের মধ্যে আমার তো মনে হয়। আর খুনটুন হবে না।
শংকর হাসতে হাসতে বললে, আপনি গুণতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?
না, গুণতে ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারিদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।
যাহোক, শংকর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামী কাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয়। সেই আদেশ দিয়ে দিল।
বিমলবাবুকঁচুমাচু ভাবে বললে,আবার ঐ ভূতপ্ৰেতগুলোকে চটাবেন স্যার। আমি আপনার most obedient servant, যা দেবেন, with life তাই করবো। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মতো একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার। ভূতপ্রেতের ব্যাপার। কখন কি ঘটে যায়।
শংকর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান সব ব্যবস্থা করুনগে যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু করতে পারে।
কিন্তু স্যার।
যান যান রাত্রি হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি।
বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কী বলুন? আমি আপনাদের most obedient and humble servant বইত নয়।
বিমলবাবু চলে গেলেন।
বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভলভারটা গুঁজে গায়ে একটা কালো রঙের ফারের ওভারকেট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল।
পায়ে চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা গুড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিকে বরাবর চলে গেছে।
সুব্রত এগিয়ে চলে, পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতিমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলো, জ্বলে আর নিভে, নিভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমের হাওয়া হিল হিল করে বহে যায়।
সর্বাঙ্গ শির শির করে ওঠে।
কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে।
সুব্ৰত এগিয়ে চলে।
অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীল-কুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধুম্রােচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়।
চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, তার শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালু-রাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকে বেঁকে আপনি খেয়াল খুশিতে অদূরবর্তী পলাশ বনের ভিতর দিয়ে বির বির করে কোথায় বহে চলেছে কে জানে?
পলাশ বনের উত্তর দিকে ৬ ও ৭ নম্বর কুলি ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশীর আওয়াজ শোনা যায়।
সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরা পাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস-সি শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।