একদিন শ্ৰীলেখা এক প্রকার জোর করেই যুঁইকে নিজেদের বাড়ি ওদের বাড়ির গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল।
ধনী গৃহে ঐশ্বর্যের অফুরন্ত সমারোহ। যুঁই বিস্ময়ে হাঁ করে চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখএত লাগল।
মস্ত বড় প্ৰকাণ্ড বাড়ি।
ঘরে ঘরে সব কাপেট পাতা। দেওয়ালে দেওয়ালে দামী দামী সব বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবি।
ঘরের কোণে টিপয়ে রাখা কাশ্মীরি টবে পােমট্রি। শ্ৰীলেখার পড়বার ঘরটিই বা কি সুন্দর। একাধারে একটি দামী টেবিল, তাতে শ্ৰীলেখার পড়বার বইগুলি ইতস্ততঃ ছড়ানো, টেবিলের উপর ফুলদানীতে এক গোছারজনীগন্ধা, দেওয়াল আলমারী ঠাসা সব গল্পের বই ও ছবির বই; পাশেই শোবার ঘর। দামী পালঙ্কে দুধের মত সাদা ধবধবে পাখীর পালকের মত নরম বিছানা।
দামী শ্বেত পাথরের প্লেটে করে নানা রকমের খাবার সব সাজিয়ে নিয়ে এল। যুঁই জীবনে এমন সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত খাবার আস্বাদনের সুযোগ একেবারে পায়নি বললেও চলে।
শ্ৰীলেখার মা বিভাবতীও এসে যুঁই এর সঙ্গে আলাপ করলেন। যেমন অমায়িক তেমনি হাসিখুশি।
এরপর একদিন শ্ৰীলেখা নিজে যেচে স্কুলেব ছুটির পর যুঁইয়ের বাড়িতে গেল।
দুখানি মাত্র ঘর নিয়ে যুঁইদের সংসার।
একখানায় যুঁই ও তার মা রাত্রে শোন ও যুঁই পড়াশুনা করে। অন্যটায় ওদের গৃহস্থলী ও রান্না খাওয়া দাওয়া হয়।
গোছগাছ ফিটফাট, কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই। ছোট্ট একখানি কেরোসিন কাঠের টেবিল। তার উপরে সযত্ন পরিপটি করে যুঁইয়ের পড়বার বই ও খাতাপত্ৰ সাজান গুছান।
সামনেই যুঁইয়ের বাবার ফটো।
কী সৌম্যমূর্তি।
যুঁই হাসতে হাসতে বললে, গরীব বান্ধবী। তোমার মত বড়লোক বান্ধবীকে বসাতে পারি। এমন যোগ্য আসনই বা আমার কোথায়?
শ্রীলেখা কৃত্রিম অভিমানে মুখখানি ভারী করে বললে, বন্ধুত্বের কাছে আবার গরীব বড়লোক কি? তুমি আমার বন্ধু। আমি তোমার বন্ধু। তুমি যেমন আমায় ভালবাস। আমিও তেমনি তোমায় ভালবাসি। সেইটাই তো আমাদের একমাত্র ও সত্যিকর পরিচয়। অন্তরের মিল যেখানে আছে, বাইরের খোলসটার সেখানে কতটুকুই বা দাম।
এমনি করে উভয়ের বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হতে থাকে। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা ওদের দিকে চেয়ে আড়ালে চোখ টিপে হাসাহসি করে।
কিন্তু ওদের যেন কোন কিছুতেই একটুকুও ক্ৰক্ষেপ নেই।
ওরা নিজেদের নিয়ে নিজেরাই বিভোর।
শশাঙ্কমোহন ভাইয়ের তার পেয়ে তাড়াতাড়ি শিলং থেকে ফিরে এসেছিলেন।
করালীর হত্যার ব্যাপারে সত্যই তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যেন। একটা পাখী পুষিলেও মানুষের তার উপরে মায়া পড়ে, তা এ তো মানুষ। এবং একদিন দুদিন নয় একাদিক্ৰমে ২১ বৎসর সে এ বাড়ীতে আছে।
শ্ৰীলেখা তো কেঁদেই খুন।
মৃগাঙ্ক শশাঙ্কমোহনকে বুঝিয়েছেন, করালী আত্মহত্যা করে মারা গেছে।
কিন্তু কেন? হঠাৎ সেই বা আত্মহত্যা করতে গেল কেন?
কিইবা এমন ব্যাপার ঘটতে পারে যার জন্য তাকে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হলো।
আরো দু’চার দিন পরের কথা।
করালীর মৃত্যুর পর থেকে শশাঙ্ক চৌধুরী যেন একটু গভীর হয়ে গেছেন।
প্রায়ই দেখা যায় তিনি চুপচাপ একাকী বসে কি যেন ভাবেন।
সেদিনও বাইরের ঘরে চুপটি করে বসে আছেন, এমন সময় একজন উড়ে চাকর এসে দরজার উপরে দাঁড়াল-শরবতের গ্লাস নিয়ে।
শশাঙ্কমোহন যেন একুট বিস্মিত হয়েই নতুন চাকরিটার মুখের দিকে তাকান।
কে তুই?
আজ্ঞে, মু রঘুনাথ আছি
রঘুনাথ?
এমন সময় অশোক এসে ঘরে ঢোকে।
অশোকই বলে রঘুনাথকে দিন কয়েক হলো কাজে বহাল করা
হয়েছে— করালীর মৃত্যুর পর শশাঙ্কমোহনের নিজের কাজকর্ম করে দেবার জন্য।
০৮. ছায়া না কায়া
রাত্রি অনেক হয়েছে। কিন্তু এখনো শশাঙ্কমোহনের প্রাইভেট রুমে আলো জুলছে। মৃগাঙ্কমোহন হঠাৎ কাল বিকালে একটা জরুরী তার পেয়ে কোথায় যেন গেছে। আজকাল প্রায়ই ঘনঘন সে দু এক দিনের জন্য শ্ৰীপুর থেকে চলে যায়। আবার হঠাৎ একদিন ফিরে আসে।
এক জোড়া তীক্ষু চোখের দৃষ্টি নীচের বাগানে করবী গাছটোব আড়াল থেকে শশাঙ্কমোহনের দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন দেখছে।
হঠাৎ এমন সময় শশাঙ্কমোহনের ঘরের বাতি নিভে গেল। নিমেষে। নিশিছিদ্র আঁধারে সমস্ত ঘরটা ভরে উঠলো।
চোখ দুটো তখনো কিন্তু করবী গাছটা আড়াল থেকে একইভাবে শশাঙ্কমোহনের ঘরের দিকে তাকিয়ে। বাইরে ক্ষীণ চাদের আলো যেন শ্রাবণ আকাশের মেঘস্তর ভেদ করে ঝাপসা ক্ষীণ মনে হয়।
সমস্ত জমিদার বাড়ী একেবারে নিস্তব্ধ নিঝুম আঁধারে ছায়ার মত স্তুপীকৃত হয়ে আছে।
চোখ দুটো দেখতে পায়, শশাঙ্কমোহনের ঘরের মধ্যে একটা অস্পষ্ট সাদা ছায়া এদিক ওদিক নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে।
অন্ধকারে করবী গাছটার আড়াল থেকে বিড়ালের মত নিঃশব্দে। আপাদমস্তক কালীে কাপড়ে ঢাকা একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো, তারপর সেই ছায়ামূর্তি কাছাড়ি বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
জমিদারবাবুর বসবার ঘরের ঠিক পাশ দিয়ে, যেখান থেকে উপরে উঠবার সিঁড়িটা-ছায়ামূর্তি সেই দিকে এগিয়ে চলল, তারপর নিঃশব্দে দুটো করে সিঁড়ি এক এক লাফে ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠে গেল।
টানা বারান্দাটা রাতের নিঃসঙ্গ আঁধারে খ খ করে। মাঝে মাঝে ঝোলান কানিশের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষীণ অস্পষ্ট চাদের আলো বারান্দার উপরে এসে এখানে একটু ওখানে একটু করে ছড়িয়ে পড়েছে।
চোরের মত পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ছায়ামূর্তি শিকারী বিড়ালের মত এগুতে লাগল রেলিং ঘেঁষে।