টেবিলের উপর থেকে শশাঙ্কমোহনের খোলা ঝর্ণ কলমটা তুলে নিয়ে ভদ্রলোক খস খস করে কি একটা লিখে শশাঙ্কমোহনের দিকে এগিয়ে ধরলেন তীর চোখের দৃষ্টির সামনে।
শশাঙ্কমোহন বিস্ময়ে যেন একেবারে থ’ হয়ে গেছেন। এ শুধু অভাবনীয়ই নয়, একেবারে যাকে বলে অচিন্তনীয়। তিনি নীবাবে পলকহারা দৃষ্টিতে সেই ক্লিপ কাগজটার গায়ে কালি দিয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়েই রইলেন।
সত্যই তিনি যেন বোবা হয়ে গেছেন। লোকটা কি অন্তর্যামী? না যাদুবিদ্যা জানে?
ভদ্রলোক শশাঙ্কমোহনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার, এবার উঠবো, বলতে বলতে ভদ্রলোক নিঃশব্দ ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
ধীরে ধীরে জুতোর শব্দ বারান্দায় মিলিয়ে গেল।
ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরও শশাঙ্কমোহন। একইভাবে স্থানুর মতই বহুক্ষণ চেয়ারটার উপর বসে রইলেন।
ইতিমধ্যে অশোক এসে একবার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে গেল।
মনে হলো শশাঙ্কমোহন কী যেন একটা বিষয় গভীরভাবে ভাবছেন।
সহসা একমাসয় শশাঙ্কমোহন চেয়ার ছেড়ে উঠে আগে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের মধ্যস্থলে রক্ষিত একটা বইয়ের আলমারী চাবি দিয়ে খুলে সাজান বইগুলির পিছনে কী যেন অতি ব্যস্ততার সঙ্গে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন।
বোধ হল, যা তিনি খুঁজছিলেন তা পেলেন না। একে একে আলমারীর প্ৰত্যেকটি সেলফ থেকে সাজান বইগুলি মাটিতে নামিয়ে আরো ভাল করে। খুঁজতে লাগলেন। ক্রমেই তার সমস্ত মুখের রেখাগুলি গভীর চিস্তায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। চোখের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ ও খর সন্ধানী। একে একে শশাঙ্কমোহন আলমারীর সমস্ত তাকগুলিই খুঁজলেন।
কিন্তু তার অভীষ্ট বস্তুর কোন সন্ধানই মিলল না।
একে একে তিনি ঘরের তিনটি আলমারীই তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। সহসা তঁর কণ্ঠ দিয়ে গভীর হতাশার একটা অস্ফুর্ট শব্দ বেরিয়ে এল। আশ্চর্য, সেই খামটা উড়ে গেল নাকি? হঠাৎ ঐ সময় শশাঙ্কমোহনের নজরে পড়ে বন্ধ দরজায় কি-হোলের সরু ছিদ্রপথ দিয়ে একটা সরু সূর্যের আলোর রশ্মি ঘরের কাপেটটার উপর পড়েই আবার মিলিয়ে গেল। আবার আলোটা দেখা গেল একটু পরেই। শশাঙ্কমোহন চিন্তিত মনে সেদিকে তাকিয়ে আলোর রশ্মিটাকে অনুসরণ করে দরজার দিকে নজর করতেই কী একটা সন্দেহ যেন তঁর মনে চকিতে উঁকি দিয়ে গেল। আলোটা তখন আর দেখা যাচ্ছে না।
সহসা আলোটা আবার ঘরের মধ্যে জেগে উঠল। এবং পরীক্ষণেই বাইরের বারান্দায় যেন কোন লোকের দ্রুত পলায়ণের শব্দ শোনা গেল।
তাড়াতাড়ি.এগিয়ে এসে ল্যাচুকি-টার চাবি ঘুরিয়ে একটান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন।
বৈকালের পড়ন্ত রোদ টানা বারান্দাটায় রেলিংয়ের কোল ঘেঁষে সার বাঁধা টবে সাজান পামট্রি-গুলির সরু চিকন পাতার গায়ে শেষ পরশটুকু বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।
বারান্দাটা একেবারে খালি। ত্ৰিসীমানাতেও কাউকে চোখে পড়ল না।
নির্জন বারান্দাটা একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সাধারণতঃ দোতলার এদিকটা নির্জন। লোকজনের যাতায়াত নেই। অন্দর মহলের সঙ্গে এদিকটার কোন যোগাযোগ নেই।
বাইরে থেকে সিঁড়ি দিয়ে এদিকে আসা যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য।
শশাঙ্ক মোহন বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চারপাশে ভাল করে লক্ষ্য করে দেখে এলেন। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। মানুষ তো দুরের কথা, একটি ছায়া পর্যন্ত নয়।—অথচ একথা সত্য যে “কি-হোলের” ছিদ্রপথ দিয়ে নিশ্চই কেউ শশাঙ্কমোহনের কাজ গোপনে লক্ষ্য করছিল। কিন্তু কে সে? কার এতবড় বুকের পটা স্বয়ং কতাঁর ঘরে এমন করে লুকিয়ে আড়ি পাতে? কে? কে?
০৭. নতুন চাকর
জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর সংসারে আপনার জনের মধ্যে স্ত্রী-একমাত্র মেয়ে শ্ৰীলেখা ও তীর খুল্লতাত ভাই মৃগাঙ্ক। শ্ৰীলেখার বয়স ১৬ বছর।
শ্ৰীলেখা স্কুলে পড়ে—এক বছর পরে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে। যুঁই, হেনা, রমা, টুনি-ওর এখন কত বন্ধু। বড় লোকের মেয়ে হলে কি হয়। মনে কিন্তু ওর এতটুকু অহঙ্কার নেই।
যেমনি মিশুকে তেমনি হাসিখুশি।
সকলেই ওর ব্যবহারে ভারি সন্তুষ্ট।
ওর সব চাইতে প্রিয় বান্ধবী হচ্ছে যুঁই। যুঁই গরীবের মেয়ে, ত্রিসংসারে ওর একমাত্র বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই।
ওর মা স্থানীয় মেয়ে। স্কুলে সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে যে কয়টি টাকা পান। তাইতেই ওদের সংসার, মা আর মেয়ের কোন মতে চলে যায়।
স্কুলে যেদিন শ্ৰীলেখা প্রথম যায় সেই দিনই যুঁইয়ের সঙ্গে ওর ভাব হয়।
রোগ ছিপছিপে গড়ন কালো মেয়েটি। মাথা ভর্তি চুল।
বড় বড় ভাসা ভাসা দুটো চোখ। সর্বদাই যেন তাতে জল ভরে আছে। হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি।
শ্ৰীলেখা নিজেই এসে ওর সঙ্গে আগে কথা বলে, কি নাম তোমার ভাই।
যুঁই তার ডাগর দুটি চোখ তুলে বিস্মিত হয়ে শ্ৰীলেখার দিকে তাকায়।
কি সুন্দর শ্ৰীলেখার চেহারা। তার উপরে দামী শাড়িতে শ্ৰীলেখাকে ভারী মানিয়েছিল। মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসিতে ঠোঁট দুটি ভরিয়ে শ্ৰীলেখা জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছো?
তোমাকে-মৃদু সঙ্কোচভরা কণ্ঠে যুঁই জবাব দেয়।
আমাকে? কেন? আমার বুঝি দুটো মাথা, চারটে চোখ?
না তা তো নয়, কিন্তু তোমার নাম কি ভাই?
শ্ৰীলেখা-তোমার নাম?
আমার নাম যুঁই।
যুঁই? বা, ভারি সুন্দর নামটি তো তোমার।
আর তোমার! যুঁই হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল।
তোমার নামের মত তাই বলে সুন্দর নয় মিষ্টি নয়।