কোথা থেকে জানলেন কথাটা। বিস্ময়ে যেন হতবাক শশাঙ্কমোহন।
জেনেছি।–সত্যি কিনা বলুন।
সত্যি-কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি একান্ত গোপনীয়, ঐ ব্যাপারটা যা একমাত্র আমি ছাড়া কেউ জানে না, সে কথাটা আপনি কোথা থেকে কেমন করে জানলেন।
ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। আমরা যে অনেক কিছুই জানতে পারি— জানতে আমাদের হয়, নচেৎ এই খুন-জখম ইত্যাদির রহস্যকে উদঘাটন করবো কি করে।
অতঃপর শশাঙ্কমোহনকে মনে হলো যেন বেশ একটু চিন্তিত।
যাক সে কথা, আচ্ছা। আপনি বলছেন কথাটা কেউ জানে না-মৃগাঙ্কবাবুও কি জানেন না?
জানো না বলেই তো এতকাল ধারণা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—
কি-বলুন?
না, কিছু না।
মিঃ চৌধুরী—
বলুন।
আপনার পিতার মৃত্যুর দু-বছর পরে আপনার সন্তান হয়, তাই না?
হ্যাঁ–
আর সে সন্তান কি সত্যিই একটি মেয়েই হয়েছিল?
হ্যাঁ–শ্ৰীলেখা আমার মেয়ে–
কিন্তু, আমি যদি বলি–
কি?
ঐ শ্ৰীলেখা আপনার সন্তান আদৌ নয়—
মানে! চমকে শশাঙ্কমোহন আগন্তুকের মুখের দিকে তাকান।
তার মানে মেয়ে নয়, আসলে হয়েছিল আপনার একটি পুত্ৰ সন্তান এবং জন্ম মুহুর্তে সে অপহৃত হয়েছিল এবং আজো সে বেঁচে আছে বলেই আপনি জানেন।
শশাঙ্কমোহন সত্যিই একেবারে স্তম্ভিত-নির্বাক! আজি দীর্ঘ ষোল বছর। ধরে যে কথা কেউ জানে না-সেই কথাটা কি করে ঐ ভদ্রলোক জানতে পারলেন।
ধীরে ধীরে এক সময় আবার ভদ্রলোক মুখ তুললেন। বললেন, বুঝতে পারছি আমরা যা জেনেছি তা মিথ্যা নয়, সত্যি–
না, মিথ্যা নয়-সত্যি–সব সত্যি–
ভদ্রলোক আবার বললেন, হয়ত এ ভালই হলো মিঃ চৌধুরী-আপনার যে পুত্ৰ সন্তান হয়েছিল এবং যে পুত্র সন্তানকে কেউ না কেউ চক্রান্ত করে তার জন্মের পর তার মায়ের বুক থেকে তঁর অজ্ঞাতে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আজও যখন সে জীবিত তাকে হয়ত আবার আমরা খুঁজে বের করতে পারব।–কিন্তু আমি ভাবছি, একটা কথা। আপনি যদি জানতেনই ব্যাপারটা তো-পুলিশের সাহায্য নেন নি কেন-কেন এতদিন চুপ করে মুখ বুঁজে আছেন–
তারা-তারা আমায় ভয় দেখিয়েছিল—
ভয়!
হ্যাঁ–বলেছিল যদি তাকে খোঁজ করবার কোন রকম চেষ্টা করি তো—তারা তাকে হত্যা করবে। তাই-তাই পারিনি-পাছে তাকে জন্মের মত হারাতে হয় বলে-বলতে বলতে শশাঙ্ক মোহন যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
আচ্ছ মিঃ চৌধুরী-আপনার স্ত্রী-আপনার স্ত্রী জানেন কথাটা?
না।
জানেন না তাহলে তিনি?
না।
ঠিক আছে। এবারে আমি আজকের মত উঠবো শশাঙ্কবাবু–
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।
০৬. শশাঙ্কমোহনের চিন্তা
একটা কথা, আপনি—আপনি পরিচয় দিলেন। আপনি পুলিশের লোক—
আপনার নামটা–শশাঙ্কমোহন প্রশ্ন করলেন।
আমার নাম–ধুর্জটী প্ৰসাদ রায়—
ধূর্জন্টী বাবু, একটা কথা আপনাকে আমি সত্যি বলিনি–
কি কথা?
আমার সেই অপহৃত ছেলের খোঁজ করিনি-কথাটা সত্য নয়-আর–
আর–
আর আসল ব্যাপারটা আমি জানতে পারি মাত্র চার বৎসর আগে-তার আগে কিছুই জানতাম না।
কেমন করে জানলেন?
একটা উড়ো অজ্ঞাতনামা লোকের চিঠিতে–
তারপর?
সেই চিঠিতেই লেখা ছিল যেন সে ছেলের খোজ আমি না করি। তবু—তবু— আমি খোঁজ না করে তাকে পারিনি-এবং–
বলুন, থামলেন কেন?
খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারি হরমোহিনী অনাথ আশ্রমে সে গোত্র পরিচয়হীন-সুধীর নামে যে ছেলেটি রয়েছে সেই ছেলেটি–
তারপর–
খোঁজ পেলেও কি করব ঠিক করতে তখনো পারছিলাম না-পত্ৰ প্রেরক যেরকম ভয় দেখিয়েছে যদি সত্যি সত্যিই ছেলেকে আমার হত্যা করে-তাছাড়া-সমস্ত প্ৰমাণাদি তখনো জোগাড় করে উঠতে পারি নি—এবং ঠিক সেই সময়
কি?
একদিন লোভ সম্বরণ করতে না পেরে যখন তাকে একটিবার দেখবার জন্য হরমোহিনী আশ্রমে গিয়ে হাজির হলাম-শুনলাম—
বলুন–
মাত্র কয়েকদিন আগে এক রাত্ৰে নাকি অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে সেই ছেলেটি আশ্রম থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই থেকে কত জায়গায় কত ভাবেই না চারবছর ধরে আমার সেই হারান ছেলের খোজ করেছি। কিন্তু তার সন্ধান পেলাম না। আজ পর্যন্তও। শশাঙ্কমোহনের কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন অশ্রুভারে জড়িয়ে আসে।
আশ্রম থেকে ছেলে অদৃশ্য হয়ে গেল। এতো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার, আচ্ছা আশ্রম থেকে সেই ছেলে যখন অদৃশ্য হয়ে যায় তখন তার বয়স কত ছিল?
বার বছর। শশাঙ্কমোহন উত্তর দিলেন।
আচ্ছা সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে সংক্রান্ত কোন পরিচয়ের নিশানা কি আপনার কাছে আছে? ভদ্রলোক প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ আছে, ঐ আশ্রমেই পাওয়া। আশ্রমের ছেলেদের একটা গ্রুপ ফটো, তার মধ্যে ঐ ছেলেটিরও ফটো ছিল। সেটা আমি আলাদা করে এনলার্জ করে রেখে দিয়েছি। খুঁজবার সুবিধা হবে বলে। তাছাড়া ছেকুলটির গায়ের রং ফর্সা। ডান ভ্রূর ঠিক উপরেই একটা লাল জরুলের চিহ্ন আছে। রোগা ছিপছিপে গড়ন।
কিন্তু একটা কথা। এই ছেলেই যে আপনার সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে তার আর কোন সঠিক প্রমাণ পেয়েছেন কি?
এ্যাঁ, তা হ্যাঁ। মানে আমার ছেলে যেদিন জন্মায় সেইদিন ও আশ্রমে সুধীরের যে জন্ম তারিখ দেওয়া ছিল, সে দুটোই একই দিন। আর তা ছাড়া যারা যড়যন্ত্র করে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন….।
ভদ্রলোক শশাঙ্কমোহনের মুখের কথাটা একপ্রকার প্রায় লুফে নিয়েই হাসতে হাসতে বললেন, আপনাদের… আচ্ছ একটা কাগজ দিন তো, বলে ভদ্রলোক শশাঙ্কমোহনের মুখের দিকে তাকালেন।
শশাঙ্কমোহন একান্ত বিস্মিত হয়েই একখণ্ড স্লিপ পেপার ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলেন।