আমি কে, তার পরিচয় আপনাকে আমি দিতে চাইনা। শুধু জেনে রাখুন আমি চৌধুরীদের একজন পরম শুভাকাঙ্খী–বর্তমানে কোন কারণে পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক। নমস্কার,
ইতি অপরিচিত।
চিঠিটা পড়ে শেষ করল কিরীটী।
আশ্চর্য তো! সুব্রত বলে।
এখন দেখছিস করালীর হত্যা ব্যাপার যতখানি সহজ ভেবেছিলাম আসলে ঠিক ততখানি নয়। মানে অগাধ জল। কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
চিঠিটার ওপরে পোস্ট অফিসের ছাপটা কোথাকার?
সুব্রতর প্রশ্নের জবাবে কিরীটী বলে, আছে অবিশ্যি একটা পোস্ট অফিসের ছাপ কিন্তু তাতে তার কোন মুশকিল আশান হবে না–
কেন?
কারণ যে আতখানি সতর্কতা অবলম্বন করতে পেরেছে, ওটুকু বুদ্ধি তার কাছে থেকে আমি আশা করি।
তারপর একটু থেমে বলে, চিঠিতে বড়বাজার পোস্ট অফিসের ছাপ রয়েছে—কিন্তু অপরিচিত বন্ধু আমার যত চালাকিই খেলুন গলদ একটু বেরিয়ে পড়েছে। তবে তার জন্য তাকে দোষ দিই না। মানুষ সব সইতে পারে, পারে না শুধু সইতে নিজের স্বার্থে আঘাত। তখন তার হিতাহিত জ্ঞানটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায় এমন দৃষ্টান্তেরও এ-দুনিয়ায় অভাব নেই।
সুব্রত এবারে প্রশ্ন করে, কে ঐ চিঠিটা লিখেছে বলে তোর মনে হয় কিরীটী?
নিঃসন্দেহে কোন interested party অর্থাৎ যার এ ব্যাপারে স্বার্থ রয়েছে। এবং সে হয়ত স্বার্থ থাকলেও কোন কারণে সামনা সামনি এসে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু সে যাই হোক-করালীচরণের ব্যাপারটা যে হত্যাই সেটাও যেমন এখন সুনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে তেমনি সেই হত্যার মূলে একটা গভীর রহস্যও আছে বলে মনে হচ্ছে।
তা হলে?
তঃপর কিরীটী সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, ব্যাপারটা একটু বেশী রকম প্যাচ খেয়ে গেল আর সেই প্যাচ খুলতে একটু বেগ পেতে হবে। তা হোক, তার জন্য আমি ভয় পাইনা। আপাততঃ অপরিচিত বন্ধুটির কথাই সত্যি বলে মেনে নিয়ে আমরা কাজে অগ্রসর হবো।
কিভাবে শুরু করবি ভাবছিস? কালই জলে নেমে প্রথম ডুব দেবো। দেখি কতদূর কি হ’ল?
সুব্রত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, কোথাকার জলে? সাগরের, না গঙ্গার?
কিরীটী হেসে ফেললে, না ভাই সাগরের জলে ডুব দিতে সাহস নেই। শোনা যায়। তার নাকি তল নেই। আর মা গঙ্গা? অতি পুণ্য কি আর আমার মত পাপীর সইবে? তার চাইতে দেখি শ্ৰীপুরের এঁদো পুকুরে একটা ডুব দিয়ে। ধনরত্ন না মিলুক দু’চারটে শামুক বা গুগলি-ও তো হাতে ঠেকতে পারে।
দেখিস, শেষে কাদা ঘটাই যেন না। সারা হয়।
দেখি।
ইতিমধ্যে মৃগাঙ্কমোহনের তার পেয়ে জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরী শিলং থেকে শ্ৰীপুরে ফিরে এসেছিলেন।
০৫. কবুলতি
দ্বিপ্রহরে শশাঙ্ক চৌধুরী সাধারণতঃ তাঁর প্রাইভেট রুমে বসে স্টেটের যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশুনা করেন। সে সময়টা সাধারণতঃ বড় একটা কারো সঙ্গে তিনি দেখাশুনা করেন না।
একান্ত প্রয়োজনীয় হলে অবিশ্যি আলাদা কথা।
করালীর মৃত্যুর দিন চারেক পরে। সে দিনও দুপুরে যখন তিনি প্ৰাইভেট রুমে বসে কাগজপত্র দেখাশুনা, করছিলেন, এমন সময় চাকর মধু এসে জানােল একজন পুলিশের লোক কি একটা বিশেষ জরুরী কাজে তীর সঙ্গে দেখা করতে চান, এখুনি।
শশাঙ্কমোহন বললেন, তাকে আমার বসবার ঘরে বসাগে যা, আমি আসছি। অশোক পাশেই একটা চেয়ারে বসে শশাঙ্কমোহনকে কি আবশ্যকীয় কাগজপত্ৰ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, শশাঙ্কমোহন ওর দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর অশোক। দেখে আসি পুলিশ আবার কেন এলো এ সময়—
একজন ছাব্বিশ সাতাশ বৎসর বয়সী যুবক-ব্যাক ব্ৰাস করা মাথার চুল, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। সরু বাটার ফ্লাই গোঁফ।
চোখে কালো কাঁচের চশমা। সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবী পরা। ড্রয়িং রুমে একটা সোফার উপর ঠেস দিয়ে বসে সেদিনকার খবরের কাগজটা পড়ছিল। শশাঙ্কমোহনের জুতোর আওয়াজ পেয়ে কাগজটা নামিয়ে মুখ তুলে তাকাল।
আপনি?
আমারই নাম শশাঙ্ক চৌধুরী।
নমস্কার, আমি সি, আই, ডি থেকে আসছি, কারালীচরণের হত্যার ব্যাপারে কয়েকটা কথা আমাদের জানা দরকার–
বলুন, কি কথা?
আপনি বসুন। দেখুন, বলছিলাম কি, কথাটা একটু গোপনীয়, এ ঘর…
আচ্ছা আসুন, আমার অফিস রুমে চলুন।
শশাঙ্কমোহনের পিছু পিছু আগন্তুক ভদ্রলোক দোতলায় নিজের অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে প্রবেশ করে শশাঙ্কমোহন অশোককে ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে যেতে বললেন। অশোক ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘরটাকে সত্যিই নির্জন বলা যেতে পারে।
ঘরটা আকারে মাঝারি রকমের হবে।
ঘরের একটি মাত্র দরজা।
ঘরের নীচেই বাগান। সেই দিকে গোটা দুই জানালা। জানালায় সবুজ পর্দা ঝোলান।
ঘরের মধ্যে একটা গোল টেবিল। টেবিলের এক পাশে ফোন। গোটা দুই চেয়ার ও গোটা চারেক আলমারী। প্রত্যেকটি আলমারী ঠাসা ইংরাজী বাংলা সব বই। ইঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসতে বলে, নিজে অন্য চেয়ারটা অধিকার করে শশাঙ্কমোহন বললেন, এইবার বলুন আপনার কি জিজ্ঞাস্য।
ভদ্রলোক শশাঙ্কমোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, বুঝতেই পারছেন আপনাদের পুরানো ভৃত্য করালীচরণের হত্যার ব্যাপারে এখানে আমি এসেছি। তাই চৌধুরী বাড়ির পুরাতন ইতিহাস আমার কিছু জানা দরকার। তারপর একটু থেমে বললেন, আচ্ছ একথা কি সত্যি যে আজ থেকে ষোল বছর আগে আপনার পিতা অনঙ্গ চৌধুরী মশাই মারা যাওয়ার পর তার উইলে জানা যায় আপনার কোন পুত্ৰ সন্তান না হলে সম্পত্তির অর্ধেক মাত্র আপনি পাবেন এবং বাকী অর্ধেক আপনার খুল্লতাত ভাই মৃগাঙ্কবাবু পাবেন?