সুনীল বলে চলে, অদেখা সমুদ্রের ডাক তোর কানে পৌঁছায় না? সীমাহীন মরু তোর প্রাণে স্বপ্ন জাগায় না? তুই একটা মানুষ!
পানু দাদার কথায় হাসে-বলে, তবে কি দাদা?
তুই, তুই মার একটা ছোট্ট খোকন মণি সোনা। তোমায় কে মেরেছে ঠোনা। আদর করে চুমো দেবো, গড়িয়ে দেবো দানা।
মা এসে ঘরে ঢোকেন। সুনু আবার পানুর মাথা খাচ্ছিস। নিজের তো খেয়ালের অন্ত নেই, আবার ওকে নাচাস কেন?
ভয় নেই মা। তোমার ও money bagটি লুট করব না। বলতে বলতে স্যাণ্ডেল ফটু ফটু করতে করতে সুনীল দরজার বাইরে পা বাড়ায়।
আবার এই অবেলায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? মা বলেন। খাবার আনতে বললি–
এখন নয়। মা-এখন নয়, একটু ঘুরে আসছি—বলতে বলতে সুনীল অদৃশ্য হয়।
কাল থেকে কলেজে গ্ৰীষ্মের ছুটি শুরু।
সকালবেলা উঠে চেয়ারে বসে টাইমটেবিলটা খুলে সুনীল আপন মনে পাতা উল্টে চলেছে, এই লম্বা ছুটিটায় কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে? কতদূর পর্যন্ত? পেশোয়ার গেলে মন্দ হত না। তবে একটু বেশী দূর এই যা।
একপাশে বসে পানু কী একটা বই পড়ছে।
জলখাবারের প্লেট হাতে মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
সকল বেলাতেই টাইম টেবল নিয়ে বসেছিল কেন?
সুনীল গভীর কণ্ঠে জবাব দিল—
জননীগো, অনেক চিন্তার পর এই স্থির করি,
সুদুর পেশোয়ার ব্যারেক আসব ঘুরি।
রমা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, না, না-ওসব মতলব ছাড়-সামনের বছর না। তোর পরীক্ষা–
জানি-পরীক্ষা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে কিন্তু জীবনের এই মুহূর্তগুলো একবার গেলে আর আসবে না। বাধা দিও না জননী–প্ৰসন্ন মনে বলো, যাও-পুত্র-পেশোয়ায়-যাও।
রামা বলেন, না—
সুনীল বলে, হ্যাঁ—
পানু মৃদু মৃদু হাসে।
০৪. অদ্ভুত চিঠি
দিন দুই পরের কথা।
দুপুরের দিকে কিরীটী তার শয়ন ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
দুআঙ্গুলের ফাকে ধরা একটা জ্বলন্ত সিগ্রেট।
জংলী এসে ঘরে ঢুকলো, বাবু একটা চিঠি।
জংলী, এককাপ চা আন তো। কিরীটী চিঠিটা হাতে নিতে নিতে বলে।
জংলী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। চিঠিখনি উল্টে পাল্টে কিরীটী দেখতে লাগল। চিঠির উপরে ছাপা বড়বাজার পোস্ট অফিসের।
সযতনে খাম ছিঁড়ে কিরীটী চিঠিটা টেনে বের করলে।
চিঠিটা ইংরাজীতে টাইপ করা। চিঠিটা পড়তে পড়তে ঘন অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা আশার আলোর হঠাৎ ঝালকানি দেখতে পায়।
একবার দুবার তিনবার চিঠিটা পড়ল, তারপর প্রসন্ন মনে, চিঠিটা সযতনে পকেটে ভাঁজ করে রেখে কিরীটী চিন্তা সাগরে ডুব দিল।
জংলী এসে চা দিয়ে গেল, কোন খেয়াল নেই। হাতের সিগ্রেটটা শুধু মুখের কাছে তুলে নিয়ে মাঝে মাঝে টান দিচ্ছে।।
সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল। কি একটা বলতে গিয়ে সহসা কিরীটীর দিকে নজর পড়তেই চুপ করে গেল। সে জানত কিরীটী যখন চিন্তা করে তখন হাজার ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না, অতএব সে একটা সোফায় বসে সেদিনকার দৈনিকটায় মন দিল।
একসময় কিরীটীরই খেয়াল হতে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সুব্রত—কতক্ষণ–
অনেকক্ষণ-তারপর শ্ৰীপুর হত্যা রহস্যের কোন আলোক সম্পাত হলো—
আলোক সম্পাত?
হ্যাঁ–
না-তেমন কিছু না, তবে একটা চিঠি পেয়েছি কিছুক্ষণ পূর্বে।
চিঠি!
হ্যাঁ।
সুব্রত প্রশ্ন করে, কার চিঠি?—
শোন–
কিরীটী পকেট থেকে চিঠিটা বের করে খুলে পড়তে লাগলো-ইংরাজীতে লেখা, তবে চিঠিটার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায়।–
প্রিয় কিরীটীবাবু
শুনলাম। আপনি শ্ৰীপুরের চৌধুরী বাড়ির পুরানো ভৃত্য করালীর হত্যা রহস্যের মীমাংসার ভার নিয়েছেন। সেই কারণেই কর্তব্য বোধে আপনাকে কয়েকটা প্রয়োজনীয় কথা জানাতে চাই ঐ চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে। অর্থাৎ এই চৌধুরী পরিবার সম্বন্ধে।
জমিদার অনঙ্গমোহন চৌধুরীর একমাত্র পুত্র হচ্ছে শ্ৰীপুরের বর্তমান জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরী। অনঙ্গ চৌধুরীর জীবিতকালে তার পুত্র শশাঙ্কমোহনের কোন সন্তান হয়নি—যাই হোক অনঙ্গ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার উইলে দেখা গেল।–লেখা আছে-তাঁর মৃত্যুর পর মানে অনঙ্গ চৌধুরীর মৃত্যুর পর যদি শশাঙ্কমোহনের ছেলে হয় তবে তার সমস্ত সম্পত্তি সেই ছেলে পাবে। আর ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হয় তবে তার মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তি পাবে সেই মেয়ে আর বাকী অৰ্দ্ধেক পাবে তার খুল্লতাত পুত্ৰ মৃগাঙ্কমোহন বা ঐ মৃগাঙ্কমোহনের পুত্র বা তাঁর পরবর্তী ওয়ারিশগণ। সে আজ ১৮ বছর আগের কথা।
তারপর সবাই জানল অনঙ্গমোহনের মৃত্যুর দু-বছর পরে শশাঙ্কমোহনের একটি কন্যা সন্তান জন্মাল অর্থাৎ ঐ শ্ৰীলেখা। কিন্তু আমি জানি আসল সত্য তা নয়, শশাঙ্কমোহনের ছেলেই একটি জন্মেছিল আজ থেকে ষোল বছর আগে এক দুর্যোগের রাত্রে এবং আতুড় ঘরেই শশাঙ্কমোহনের নবজাত পুত্ৰ চুরি যায়। এবং যারা চুরি করে তারাই সেই ছেলের বদলে মেয়েকে রেখে যায়। আপনার কাছে আমার এই অনুরোধ যে, সেই চুরি যাওয়া ছেলেকে আপনার খুঁজে বের করে দিতে হবে এবং যদি বের করে দিতে পারেন বা বর্তমানে সে কোথায় আছে সে সন্ধানটুকুও এনে দিতে পারেন তাহলে আপনাকে নগদ দশ হাজার টাকা দেবো। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত থাকেন তাহলে দয়া করে আপনার বাড়ির দরজায় ‘হ্যা’ অক্ষরটি খড়ি দিয়ে লিখে রাখবেন এবং আমি আপনাকে পরদিনই পারিশ্রমিকের পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম পাঠিয়ে দেবো। বাকী কাৰ্য উদ্ধারের পর পাবেন।
একটা কথা-জন্মের সময় শিশুর ডান ত্রুর ঠিক উপরেই একটা লাল জরুল (১ ইঞ্চি পরিমাণ) ছিল।