সামনে একটা টানা বারান্দা-দোতলায়—একতলার মতই জমাট আঁধার, কিছুই দেখবার উপায় নেই।
কিরীটী পা টিপে টিপে এগিয়ে চলে।
বারান্দা যেখানে বেঁকেছে তারই সামনে যে ঘর, সেইটাতেই পানু শোয়।
মৃদু একটা ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। ওরা ঘরে পা দেয়।
ঘরের বাগানের দিককার জানালাটা খোলা।
রাতের হাওয়ায় খাটের উপর টাঙানো নেটের মশারিটা দুলে দুলে উঠছে আবছা আবছা অন্ধকারেও দেখা যায়।
কিরীটী এগিয়ে এসে নিঃশব্দে মশারিটা তুলে হস্তধৃত টর্চের বোতামটা টিপতেই বিছানাটার উপর টর্চের আলো গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
সুব্রত সভয়ে দেখলে, একটা বাঁকানো তীক্ষ্ণ ভোজালী পাশ বালিশটার গায়ে অৰ্দ্ধেকটার বেশী ঢুকে রয়েছে, শয্যা খালি।
কিরীটী হাসতে হাসতে বালিশের গা থেকে ভেজালীটা টেনে তুলে নিল। ভোজলীটার হাতলটিা হাতীর দাঁতের নানা কারুকার্য খচিত এবং সেই হাতলের গায়ে মীনা করে লেখা ‘S.C’.
এমন সময় খুঁট করে একটা শব্দ শোনা যেতেই টুক করে কিরীটী হাতের টৰ্চটা নিভিয়ে দিল।
নিমিষে নিকষ। কালো আঁধারে ঘর গেল ভরে।
পর মুহুর্তেই মনে হলো আশে পাশেই কোথাও কোন দরজা খুলে কে বুঝি নিঃশব্দে চোরের মত চুপি চুপি ঘরে ঢুকছে।
ওরা উদগ্ৰীব হয়ে ওঠে।
সহসা এমন সময় আবার কিরীটীর হাতের টর্চ জ্বলে উঠলো।
সেই আলোয় সুব্রত ও কিরীটী দেখলে তাদেরই সামনে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে শ্ৰীপুরের জমিদার স্বয়ং শশাঙ্কমোহন চৌধুরী।
তাঁর দুই চোখ দিয়ে বিহ্বল ও আতঙ্কপূর্ণ চাউনি যেন ফুটে বের হচ্ছে।
২৪. ধাঁধার উত্তর
কিরীটীর ডাকে সুব্রতর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল-ওঠ হে সুব্রত রায়। জাগো, আঁখি মেল।
ওঠ বন্ধু মুখ ধোও পর নিজ বেশ।
গরম চায়েতে মন করাহ নিবেশ।
সুব্ৰত চোখ মেলে দেখলে কিরীটীর হাতে এক কাপ ধূমায়িত গরম চা, মাঝে মাঝে সে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে।
সুব্রত তাড়াতাড়ি সলজ একটু হোেস শয্যা ছেড়ে উঠে বসল।
একটু পরে দুই বন্ধু তখন বাইরের ঘরে বসে গত রাত্রির ঘটনার আলোচনা করছে। সিঁড়িতে জুতার শব্দ শোনা গেল।
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, শ্ৰীধর ওরফে আমাদের রাজু আসছেন—
সত্যি সত্যিই রাজু এসে ঘরে প্রবেশ করল।
উৎকণ্ঠায় সে যেন হাঁপাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই একটা চেয়ারের উপর ধাপ করে বসে পড়ে বলে। তারপর? এখন সব বল।
কি ধাঁধার উত্তর তো?
হ্যাঁ।
এই নে। কিরীটী একটুকরো ভাঁজ করা কাগজ রাজুর সামনে এগিয়ে ধরল। অধীর আগ্রহে ভাঁজ করা কাগজটা রাজু খুলে ফেলল।
১ নম্বর—বোতাম : –ম +
২ নম্বর-ছয় বৎসর : –শ’ +
৩ নম্বর–চিঠি ও ফটো : শ + ম
৪ নম্বর–চিঠি : —শ—ম +
৫ নম্বর–কাটা আঙ্গুল : -ম + +
৬ নম্বর–পোড়া সিগারেট :–ম + +
(ক) করালী চরণ : শ+ / ম++
(খ) ছেলে চুরি : শ + / ম + + / ?
খানিকক্ষণ কাগজটার উপর চোখ বুলিয়ে রাজু বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, এ আবার কী?
ঐ তো তোমার আগাগোড়া সমস্ত রহস্যের মীমাংসা।
ধাঁধার উত্তর।
বুঝিয়ে দে।
তবে বলি শোন, কিরীটী সিগারেটের টিন থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করতে করতে বলতে শুরু করল।
শশাঙ্কমোহনের খুড়তুত ভাই হচ্ছে মৃগাঙ্কমোহন। আমরা উইলের ব্যাপারে জানি যে শশাঙ্ক মোহনের বাপ যে উইল করে যান তার অর্থ এই, শশাঙ্কমোহনের যদি ছেলে হয় তবে সে সম্পত্তি পাবে আর যদি মেয়ে হয় তবে অর্ধেক পাবে সেই মেয়ে আর বাকী অর্ধেক পাবে মৃগাঙ্গমোহন নিজে কিম্বা তার ওয়ারিশগণ। মৃগাঙ্গমোহন যেদিন জানতে পারলেন যে দাদার সন্তান হবে তিনি মনে মনে এক অভিসন্ধি করলেন, যদি ছেলে হয় তবে সে ছেলেকে হত্যা করে অন্য একটি মেয়েকে সেখানে বদলে রাখতে হবে। আর যদি মেয়ে হয় তবে তো কোন কথাই নেই। সব ল্যাটা চুকে যায়। কারালীচরণ ছিল চৌধুরী বাড়ির পুরাতন চাকর। সে একদিন সহসা সন্ধ্যার অন্ধকারে মৃগাঙ্গমোহনের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মৃগাঙ্কমোহনকে একজন লোকের সঙ্গে চুপিচুপি পরামর্শ করতে শোনে এবং সব কথাই তার কানো যায়।
মৃগাঙ্কমোহনের সঙ্গে ইতিপূর্বে আরো দু’একবার সেই লোকটি এসে পরামর্শ করেছে। তাও করালীচরণের নজর এড়ায়নি। কারালী কোন দিন মৃগাঙ্কমোহন কে দু’চোখে দেখতে পারত না। মৃগাঙ্ক যে সে কথা জানত না তা নয়। পুরানো চাকর হিসেবে চৌধুরী বাড়ির উপরে করালীর বেশ একটু আধিপত্যই ছিল। শশাঙ্ককে ঐ করালীই কোলে পিঠে করে একপ্রকার মানুষ করেছিল। সেইজন্যই মৃগাঙ্ক করালীর প্রতি সন্তুষ্ট না থাকলেও কিছু বলতে সাহস করত।
এই পর্যন্ত বেশ সোজা-সরল একটি ষড়যন্ত্র। তারপরেই ব্যাপারটা জটিল হয়ে গেল।
কি রকম? সুব্রত প্রশ্ন করে।
সেই কথাই এবারে বলব, কিরীটী বলতে লাগল।
স্থানীয় লেডী ডাক্তার ডাঃ মিস মল্লিকা সরখেলের সঙ্গে মৃগাঙ্কমোহনের রীতিমত একটা হৃদ্যতা ছিল, মল্লিকা মৃগাঙ্গকে বিয়ের জন্য তাকে বহুবার বলেছে কিন্তু মৃগাঙ্ক কান দেয় নি। অবশেষে মৃগাঙ্ক বললে-বিভাবতী তার বৌদি, সন্তান সম্ভাবিতা। ছেলে হবার সময় সুনিশ্চিত তার ডাক পড়বে। সেই সময় যদি একটি পুত্ৰ সন্তান হয়—এবং মল্লিকা সদ্যজাত সেই শিশুটিকে কোন মতে হত্যা করে সরিয়ে দিতে পারে তাহলে তাদের পথ পরিষ্কার। তাদের বিয়ে হতে পারে।
বলিস কি?
তাই, তবে মল্লিকা তখনো জানতে পারেনি মৃগাঙ্ক লোকটা কতবড় শয়তান!
তা একথা জানালি কি করে তুই?