সিংহী নিজের ঘরে ক্রুদ্ধ সিংহের মতই হাতদুটো পিছন করে পায়চারি করছিল। সকলে ঘরে ঢুকতে সিংহী ওদের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বললে, সব সার বেঁধে দাঁড়াও।
প্ৰথমে বিকাশের পালা। তার পিঠের উপর জোরে জোরে কয়েক ঘা বেত পড়তেই সে যন্ত্রণায় কেঁদে উঠলো।
সহসা এমন সময় সুধীর সিংহীর সামনে এসে গভীর স্বরে বললে, ওদের কোন দোষ নেই। স্যার। সব দোষ আমার। আমিই ওদের পরামর্শ দিয়ে। আশ্রমের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম, মারতে হয় আমায় মারুন।
সিংহী ত্রুকুটি করে সুধীরের দিকে তাকাল, তারপর ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, ও, তুই পালের গোদা all right —জানতাম, আমি জানতাম।
সিংহী নির্মম ভাবে সুধীরের সর্বাঙ্গে সজোরে বেত চালাতে লাগল।
সুধীর একটি শব্দ পর্যন্ত করলে না।
প্ৰায় পনের মিনিট ধরে বেত মারবার পর, সিংহী বললে, আজ যা কাল তোর বিচার হবে।
সকলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
রাত্রি গভীর। আশ্রমের সকলেই যে যার বিছানায় অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
সুধীর আস্তে আস্তে শয্যার উপর উঠে বসল।
নির্মম বেতের আঘাতে তার সর্বাঙ্গ তখনও বিষের জ্বালার মতই জ্বলছিল।
পাশেই অন্য শয্যায় শুয়ে ভিখু, বোধহয় অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
দুপুরেই কারিগর এসে জানালার শিক ফ্রেম বদলে নূতন করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। সুধীর একটা পুঁটলিতে কয়েকটা জামা কাপড় বেঁধে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রাত্রির আঁধার চারিদিকে যেন গভীর মৌনতায় খাঁ খাঁ করছে।
বারান্দা থেকে সুধীর আশ্রমের আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াল।
মাথার উপর রাতের আকাশ, শিয়রে তারার প্রদীপ জ্বলিয়ে শুধু একাকী জাগে। সমস্ত আশ্রমটা জুড়ে যেন গভীর ঘুমের চুলুনি নেমেছে। সুধীর একবার দাঁড়াল।
কত স্মৃতি বিজড়িত এতকালের আশ্রমটা যেন এক অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে তাকে পিছন থেকে টানে।
এখানকার ঘর দুয়ার সঙ্গী সাখী মনে মনে সকলের কাছ থেকে সে বিদায় নেয়।
চোখের কোল দুটো জলে ভরে ওঠে। হাত দিয়ে সুধীর চোখ দুটো মুছে নিল।
তারপর ধীরে ধীরে সে আঙ্গিনাটা পার হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে চলে।
গেটের কাছে এসে পুঁটলিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সে মালকোঁচা আঁটতে যাবে, এমন সময় তার কাঁধের উপর কার যেন হাতের স্পর্শ পেয়ে ও চমকে ফিরে তাকাল, পিছনে দাঁড়িয়ে ভিখু।
সুধীরের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, একি ভিখু?
হ্যাঁ আমি। কিন্তু তুমি এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ সুধীর?
চলে যাচ্ছি। ভাই এখান থেকে। যাক ভালই হলো? ইচ্ছা ছিল যাবার আগে তোকে বলে যাবো। কিন্তু সাহস হয়নি। পাছে তুই আমায় যেতে কোন রকম বাধা দিস।
তুমি যাচ্ছ? কিন্তু কেন চলে যাবে?
সুধীরের ওষ্ঠ্যপ্ৰান্তে করুণ একটু হাসি জেগে উঠল। বললে, এখানে আর আমি থাকতে পারলাম না ভিখু। দেখি এতবড় পৃথিবীতে এই আশ্রম ছাড়া আমার আর কোথাও স্থান মেলে। কিনা। এই আশ্রমের নিয়ম কানুন, এর অত্যাচারে আমার দম আটকে আসে। এ বন্দী জীবনে আমি অত্যন্ত হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই চলে যাচ্ছি।
তারপর হঠাৎ ফিক করে একটুখানি হেসে বললে, সিংহীটা খুব জব্দ হবে, কাল যখন সকলে উঠে দেখবে যে খাঁচার পাখী পালিয়েছে, কি বলিস? আমার ভারী ইচ্ছা করছে তখন ওর মুখের চেহারাটা কেমন হয় একবার দেখবার জন্য। যাক আমার বদলে তোরাই দেখিস।
কোথায় যাবে? ভিখু জিজ্ঞাসা করে।
কোথায় যাবো? তা তো জানিনা। আর ভাবনাই বা কিসের? এতবড় দুনিয়ায় জায়গার অভাব হবে কি?
ভিখু চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।
লোহার গেটের মাথায় সব ঘন সন্নিবেশিত ধারালো লোহার শিক বসান। সেই দিকে তাকিয়ে ভিখু প্রশ্ন করে, কিন্তু গেট পেরুবে কেমন করে?
সুধীর একটু হাসল। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে দারোয়ানের ঘরের পিছনের কামিনী গাছটার তলা থেকে পোল জাম্পের বড় বাঁশের ডাণ্ডাটা নিয়ে এল।
বাঁশটা দেখিয়ে বলে, এই দেখ, সন্ধ্যা বেলা লুকিয়ে এটা এখানে রেখে গিয়েছিলাম।
তারপর পুঁটলিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে অক্লেশে সুধীর বাঁশের ডাণ্ডাটার উপর ভর দিয়ে গেটের ওপাশে গিয়ে ভল্ট দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল।
গেটের লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে একটা হাত গলিয়ে ভিখুর একখানি হাত সস্নেহে চেপে ধরে ও বললে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিসনে, কেউ হঠাৎ দেখে ফেললে বিপদে পড়বি, যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়গে যা।
তুই দাঁড়া সুধীর আমিও তোর সঙ্গে যাবো। ভিখু বলে।
পাগলামি করিসনে ভিখু। —কোথায় যাবি আমার সঙ্গে?
তুই যেখানে যাবি।—
না ভাই তুই যা। আচ্ছা আসি-কেমন?
ভিখুর চোখের কোলে দু’ফোটা জল চিকচিক্ করে ওঠে।
ছি। ভিখু, তুই কঁদেছিস? কঁদেছিস কিরে বোকা ছেলে দুর—
ভিখু মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সুধীর ধীরে ধীরে হাঁটতে আরম্ভ করে।
সহসা তারও চোখের কোল দুটো বুঝি জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে।
সামনেই পায়ে চলার পথ রাতের আঁধারে থাম থম করছে।
হাত দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে সুধীর দ্রুত চলতে থাকে। আস্তে আস্তে একসময় রাতের অস্পষ্ট আঁধারে সুধীরের ক্রম চলমান দেহখানি একটু একটু করে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ভিখু তখনো দাঁড়িয়ে গেটের অপর দিকে।
১৭. পথহারা
রাতের আঁধারে পায়ে চলা পথটা যেন প্ৰকাণ্ড একটা ঘুমন্ত অজগরের মত নিঃসাড়া হয়ে পড়ে আছে।
পথের দুধারের বাড়িগুলো ঘুমের কাঠির ছোঁয়া পেয়ে যেন একেবারে নিশ্চল নিঝুম হয়ে পড়েছে।
কেউ কোথাও জেগে নেই।