রাত্রি দশটা হবে।
সুনীল সেই দুপুরে তার বাইকে চেপে বের হয়েছে, এখনও ফেরেনি।
পড়ার ঘরে পানু একা টেবিল ল্যাম্পটি জেলে পড়ার বই খুলে পড়ছে।
ঝড়ের মতই সুনীল এসে ঘরে ঢোকে। কি, দিন নেই রাত নেই, কেবল পড়া আর পড়া।
কে দাদা? এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে? পানু জিজ্ঞাসা করে। পাতা বিছানাটার উপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে সুনীল বলে, চল পানু কাল রবিবার আছে, বেরিয়ে পড়ি-হাঁটতে হাঁটতে যতদূর পারি চলে যাই।–তারপরই একটু থেমে বলে, উঃ যদি একটা আমার প্লেন থাকত।
পানু সহাস্যে বলে, তাহলে কি হতো দাদা?
ফাকে-উড়ে যেতম দূরে দূরে বহুদূরে—মাটির পৃথিবী অস্পষ্ট ছায়ার মতই-যেন আঁচল পেতে ঘুমিয়ে আছে। কেমন মজা হতো বলত-how thrilling!
সুনীলের চঞ্চল আঁখি দুটি স্বপ্নময় হয়ে ওঠে যেন। সুনীল আপন মনে বলে চলে–
“ওগো সূদুর, বিপুল, সুদূর তুমি যে,
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী।
মোর ডানা নাই আছি এ ঠাঁই
সে কথা যে যাই পাসরি।
আমি উৎসুখ হে,
হে সুদূর আমি প্রবাসী।
তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো
কি কথা আমায় শুনাও সতত,
তব ভাষা শুনে তোমার হাদয়
জেনেছে তাহার স্বভাষী
হে সুদূর আমি প্রবাসী।”
আমি মাঝে মাঝে কি স্বপ্ন দেখি জানিস পানু—আমি যেন উড়ে চলেছি প্লেনে —অনেক অনেক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে-স্বপ্ন দেখি আমি যেন-গভীর রাতে ঘুমহারা তারার পাশে পাশে আমি আমার প্লেনে উড়ে চলেছি। নীচে ঘুমিয়ে আছে তুষারে আচ্ছন্ন হিমালয়। তুষারের টোপর এক পায়ে ভুতের মত রাত জাগে। পাইন গাছগুলি সবুজ পাতার টোপর মাথায় ঝিমুচ্ছে। কখনও হয়ত উড়ে চলেছি জ্যোৎস্নালোকিত আকাশ পথে, নীচে ধুধু দিগন্ত বিস্তৃত সাহারার মরুভূমি। কখনও নীচে হয়ত গর্জে উঠেছে ফেনিল উত্তাল সাগরের ঢেউ।
পানু অবাক হয়ে সুনীলের কথা শোনে।
ওর দেহের প্রতি রক্তবিন্দুতে, বিন্দুতে যেন ঘর ছাড়া দিক হারার ডাক। হয়ত ও এমনি করেই একদিন সুদূরের পথে ভেসে যাবে। হয়ত ফিরবে, হয়ত বা ফিরবে না। কে জানে? ওর ভয় করে। রীতিমত ভয়ে ভয়ে ডাকে, দাদা?
সুনীলের কিন্তু খেয়াল নেই। বলে চলে, জনিস পানু, এতদিন কবে আমি হয়ত বেরিয়ে পড়তাম। কিন্তু পারিনা, মনে পড়ে মার মুখখানি, তার ব্যথা করুণ চোখের দৃষ্টি, একদিকে দূর দুরান্তের হাতছানি, অন্যদিকে মায়ের নীরব কাকুতি।
অশান্ত চঞ্চল কল্পনা পিয়াসী সুনীল। সত্যিই দাদাকে পানুর ভারী ভাল লাগে।
১০. ছিন্ন সূত্রের গ্ৰন্থি
ছায়ামূর্তির গলার ফাঁসটা আড়াআড়ি ভাবে পড়েছিল এবং ফাসটা লাগাবার সাথে সাথেই পিছনপানে এক হেঁচকাটান খেয়ে ছায়ামূর্তি আর টাল সামলাতে পারলে না। পিছন দিকে হেলে পড়ে গেল এবং পড়বার সময় মাথাটা একটা টবের গায়ে প্রচণ্ডভাবে ঠুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ও সমগ্ৰ দেহটা যেন কেমন ঝিম ঝিম করে উঠল। সমস্ত স্মৃতি কেমন অসাড় ও গুলিয়ে একাকার হয়ে গেল। ছায়ামূর্তি ক্ষীণ অস্ফুট একটা শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল।
শিথিল হাতের মুঠি থেকে একটা খাম মাটিতে পড়ে গেল। যে আততায়ী এতক্ষণ ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে তার উপর আচমকা পিছন থেকে চাদর চাপা দিয়ে ফাস লাগিয়েছিল। সে এতক্ষণে এগিয়ে এল।
ক্ষিপ্ৰহস্তে ভূপতিত ছায়ামূর্তির মাথার উপর থেকে ফাসটা খুলে চাদরটা সরিয়ে নিল।
তারপর মাটির উপর থেকে খামটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে পড়ল।
ছায়ামূর্তির জ্ঞান যখন ফিরে এল তখনও মাথাটার মধ্যে কেমন যেন বিমঝিম করছে।
মাথাটা উঁচু করতে গিয়ে মনে হল যে সেটা যেন লোহার মতই ভারী। মাথার একটা জায়গা ব্যথায় টন টন করছে। হাত দিয়ে অনুভব করে বুঝল যে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। অজ্ঞান হওয়ার আগের সমস্ত ঘটনাগুলি একে একে মনের পর্দার উপর ছায়াছবির মত ভেসে ওঠে।
হাতের উপর ভর দিয়ে লোকটা উঠে বসলো।
মেঘের আড়ালে বোধ হয় চাঁদ ঢাকা পড়েছে। চারিদিকে কালো আঁধার থমথম করে।
টচটা পাশেই পড়েছিল। একটু খুঁজতেই সেটা পাওয়া গেল।
টর্চের বোতাম টিপে আলো জেলে আহত ব্যক্তি চারিদিক খুঁজল।
কিন্তু খামটি কোথাও দেখতে পেলে না।
আশ্চর্য! কোথায় গেল সেই খামটা।
তবে কি।–এতক্ষণে আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা একটা ক্ষীণ সন্দেহের আকারে মনের কোণে উঁকি দিল।
কিন্তু কে সে?
ভোরবেলা খবরের কাগজটা পড়তে পড়তে কিরীটী রায় মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল।
শ্ৰীপুর রহস্যের কিছু কিনারা হলো? কালকের সে বস্তুটি কোন কাজে লাগল?
নিশ্চয়ই–লেগেছে বৈকি-দশ আনা হয়ে গেছে। বাকী ছয় আনা।
তার মানে, তবে তো প্ৰায় মেরে এনেছিস বল?
হ্যাঁ কতকটা। চার ফেলেছি-মাছ টোপ গিলবেই-কিন্তু ঐ যে গাছের ডালে দুটো চিল ধ্বসে আছে, তাদের নিয়েই মুশকিল বেঁধেছে।
চিল।
হ্যাঁ–
সামনেই টিপিয়ের ওপরে একটা সাদা কাগজের গায়ে কয়েকটা কথা বড় বড় অক্ষরে লেখা।
১ নম্বর– বোতাম ‘ম’
২ নম্বর– চার বৎসর ‘ম’ ‘শ’
৩ নম্বর—চিঠি ‘শ’ ‘ম’
সুব্রত টিপয়ের উপর থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়ে লেখাগুলির মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারলে না।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, এটা কি রে? কোন ধাঁধার উত্তর ঠিক করছিলি নাকি?
কিরীটী কাগজটার দিকে চোখ রেখেই জবাব দিল, না-একটা ধাঁধা তৈরি করবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মিলাতে পারলাম না।
তাই নাকি? এমন সময় জংলী সকল বেলাকগর ডাক এনে টিপয়ের উপর রাখে। কিরীটী চিঠিগুলি একটি একটি করে পড়ে নামিয়ে রাখতে লাগল।