সহসা খুঁট করে একটা শব্দ শোনা যায়।
আগাগোড়া সাদা চাদরে ঢাকা একটা মূর্তি নিঃশব্দে শশাঙ্কমোহনের ঘর থেকে বাইরে এসে দরজাটা টেনে দিল।
মুর্তি এগিয়ে চলে।
এ বারান্দারই একটা দরজা দিয়ে অন্দর মহলে যাওয়া যায়।
মুর্তি এগিয়ে এসে সেই দরজা খুলে অন্দর মহলে প্রবেশ করল।
প্রথমেই মৃগাঙ্কমোহনের ঘর।
বাইরে থেকে সেই ঘরের দরজায় একটা তালা দেওয়া। ছায়ামূর্তির হাতে একগোছা চাবি ছিল। সে একটার পর একটা চাবি দিয়ে ঘরের তালা খুলবার চেষ্টা করতে লাগল। গোটা পাঁচ ছয় চাবি চেষ্টা করার পর খুঁট করে একটা চাবি ঘুরে যেতেই তালাটা খুলে গেল।
মূর্তি তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকেই দরজা। এঁটে দিল। চাবিটা কিন্তু তালার গায়েই আটকে রইল। মূর্তির হাতে একটা ছোট শক্তিশালী টর্চ ছিল। সেটা টিপে আলো জুলিয়ে ঘরটার চারিদিক একবার ভাল করে ঘুরিয়ে দেখে নিল।
মৃগাঙ্কর যাবতীয় জিনিষপত্র একটা দেওয়াল আলমারীতেই বন্ধ থাকত। মৃগাঙ্কর স্বভাবটা ছিল চিরদিনই ভারী অগোছোল। অথচ তার মনটা ছিল অত্যন্ত সৌখিন।
সমস্ত ঘরময় ইতস্তত সব জিনিসপত্র ছড়ান। এখানে জামা ওখানে কাপড়, সেখানে জুতো ইত্যাদি সব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।
একপাশে একটা চামড়ার সুটকেশ হাঁ করে খোলা।
টেবিলের উপর গোটা পাঁচ সাত ‘ক্যাপসটেন’ সিগারেটের খালি টিন। অ্যাসট্রেটা ভর্তি একগাদা সিগারেটের ছাই জমা হয়ে আছে। ঘরের মেঝেয় একপর্দা ধুলো জমে রয়েছে। এদিক ওদিক সব পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি ছড়ান। একপাশে খাটে শয্যাটা ধুলো বালিতে ময়লা।
বিশৃঙ্খলতার যেন একখানি চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে গিয়ে আলমারীটার সামনে দাঁড়াল।
মূর্তির ডান হাতের মুঠোর মধ্যে একটা বাঁকানো মোটা লোহার তার। সেটা আলমারীর গা-তালার ফোকরে ঢুকিয়ে দিয়ে গোটা দুই জোরে মোচড় দিতেই আলমারীর কপাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল।
আলমারীটা খুলে কি যেন সে খুঁজতে লাগল।
অল্পক্ষণ খুঁজতেই মূর্তি একটা কাগজের ছোট প্যাকেট দেখতে পেল একটা বিস্কুটের খালি টিনের মধ্যে।
তাড়াতাড়ি সেই প্যাকেটটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
পিছন ফিরে চাবিটা যেমন লাগাতে যাবে সহসা কোথা থেকে ঝুপ করে এসে একটা কালো চাদরের মত মাথার উপরে পড়ল। এবং চোখের পলকে একটা ফাসের মত কী যেন গলার উপর এঁটে গেল।
০৯. চঞ্চল সুনীল
সুনীল আর পানুর মধ্যে রামার মেহটা পাণুকে ঘিরেই বেশী করে আবর্ত রচনা করে ফেরে। উদ্দাম ঝড়ো হাওয়ার মত সদাচঞ্চল সুনীল মাকে কাঁদায়।
রামার মনে সর্বদাই আশঙ্কা সুনীলের জন্য উদগ্ৰীব হয়ে থাকে। হাতের কােজ ফেলেই সুনীলকে বুকের মাঝে সস্নেহে টেনে নিয়ে তার রুক্ষ পশমের মতো এলোমেলো চুলগুলির উপর গভীর মমতায় হাত বুলাতে থাকে, সুনু বাবা আমার, দুদণ্ডও কী তুই সুস্থির হয়ে থাকতে পারিস না?
আমার জন্য তোমার বড় ভয় না মামণি? সুনীল তার ডাগর চোখ দুটি মায়ের ছলছল স্নেহ চঞ্চল দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে বলে, কেন মা তুমি আমায় বঁধতে চাও? এই চারিদিকে দেওয়াল ঘেরা ঘরের মধ্যে আমার মন হাঁপিয়ে ওঠে। পারি না। আমি থাকতে মামণি, বাইরে কেমন উদার উন্মুক্ত প্রকৃতি। মাথার উপরে সীমাহীন নীল আকাশ। কেমন করে থাক মা তুমি এ ঘরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, একটিবারও কী তোমার মন চায় না ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে যেতে? সুনীলের চোখ দুটো বাইরের আকাশে নিবদ্ধ।
কিসের ভাবে সে স্বপ্নাতুর।
সুনীল বলে চলে, আমাদের দেশের ছেলেগুলো চিরকালটা এমনি করেই মায়ের আঁচলের তলে ঘরের কোণে বদ্ধ রইলো, দেখলো না তার বাইরে বের হয়ে—জানলো না তারা বাইরে ঐ উদার উন্মুক্ত সীমাহীন প্রকৃতি কতবড় ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়ে আপনাকে আপনি দিকে দিকে বিলিয়ে দিয়েছে। শুনলে না তারা দিগন্ত প্লাবিত মুক্ত পাখীর গান। বাঁধন হারা সাগরের জলোচ্ছাস। জান মামণি-ওদের দেশের ছেলেরা একটু ছুটি পেলেই দল বেঁধে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাইতো তাদের দেশে জন্মায় কলম্বাস, লিভিংষ্টোন।
তারপর একটু থেমে আবার হয়ত বলে, আমি ছাড়াও তো তোমার আর একটি ছেলে আছে মা। তোমার পানু, সে তো ঘর থেকে বের হয়না। লক্ষ্মী ছেলেটির মত দিবারাত্র ঘরের মধ্যে বই নিয়ে বসে কাটায়। বাইরের ঐশ্বর্য ওর কাছে অন্ধকার।
পানু এসে ঘরে ঢোকে।
এই যে মা-মণি, তোমার সোনার যাদু এল। সুনীল পানুর দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বলে।
আমার নামে বুঝি, দাদা তোমার কাছে লাগাচ্ছে মামণি? পানু বলতে বলতে এগিয়ে আসে।
মা অন্য হাত বাড়িয়ে পানুকেও বুকের কাছটিতে টেনে নেয়, না রে না, দাদা যে তোকে কত ভালবাসে তাকি তুই জানিস নে পানু?
জানি মা, দাদা আমাকে সত্যি বড় ভালবাসে।
তাহলে তুমি কচু জান। সুনীল গভীর হয়ে জবাব দেয়। তোমাকে কিসসু ভালবাসে না দাদা। দাদার বয়ে গেছে। অমন ঘর-কুণো ভাইকে ভালবাসতে।
মা প্ৰসন্ন দৃষ্টিতে দুই ছেলের ঝগড়া দেখে আর মৃদু মৃদু হাসে। ওদের দাদু, রামার বাবা, বৃদ্ধ পরমেশ বাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। কিসের দরবার চলেছে রাম।
তুমি বল দাদু, মার মনে কষ্ট দিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করা ভাল, না মা যাতে করে সুখী হন, তাই করা ভাল।
আমার মতে কুণো হওয়াটাও ভাল নয়-মার কথা শোনা উচিত।
এ তোমার দাদু, মন রাখা কথা হলো, সুনীল বললে, পরমেশবাবু ও রমা। চোখ চাওয়া চাওয়ি করে হাসতে থাকেন।