- বইয়ের নামঃ রাত নিঝুম (১)
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. কিরীটী
কি বিশ্ৰী বর্ষা।
ঝর-ঝর-অবিরাম ঝরিছে তো ঝরছেই-থামবার শীগগিরী কোন সম্ভাবনাই নেই।
তাই আজ কয়দিন থেকেই কিরীটীর মনটাও ঐ বর্ষার মেঘলা আকাশটার মতই যেন ভার ভার হয়ে আছে। হাতে কোন কাজকর্মও নেই। বিশ্ৰী একঘেয়ে—কারও এ ধরণের অবসর ভালো লাগে নাকি?
সারাটা দিন ধরে একটা রহস্য উপন্যাস পড়েছে কিরীটী-বিকেলের দিকে আর ভাল লাগছিল না পড়তে। বইটা মুড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে বসবার ঘরে একটা সোফার উপর, খোলা জানােলা পথে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টি ঝরা আকাশটার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বসে ছিল।
এমন সময় টেলিফোনের বেল বেজে উঠলো, ক্রিং! ক্রিং! অনাচ্ছিার সঙ্গেই হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিলো। হ্যালো। মিঃ কিরীটী রায়? কথা বলছি—বলুন। আপনি কে? আমাকে তো আপনি চিনবেন না
কোথা থেকে কথা বলছেন? আমি শ্ৰীপুর স্টেট থেকে বলছি, জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরীর ভাই মৃগাঙ্ক চৌধুরী।
বলুন। আমাদের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে সেইজন্য আপনার সাহায্য চাই–
কি রকম দুর্ঘটনা?
দেখুন, আমাদের বাড়ির অনেকদিনকার পুরানো করালীচরণকে আজ সকালে হঠাৎ তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্থানীয় থানা থেকে দারোগীবাবু এসেছিলেন—তারা অবিশ্যি যা করবার করবেন–আর কি যে তারা করবেন তাও আমরা জানি। করালীচরণ এ বাড়ির বহুদিনকার পুরানো লোক-বলতে গেলে সে এ বাড়িরই একজন হয়ে গিয়েছিল—তাই ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুবই মর্মান্তিক হয়েছে। আমরা চাই সত্যিকারের ব্যাপারটা জানতে। তাই বলছিলাম। আপনি যদি দয়া করে আমাদের এখানে একবার আসেন। তবে বড় ভাল হয়। আমাদের মনে হয়। আপনি হয়ত এ ব্যাপারের একটা কিনারা করতে পারবেন। অবিশ্যি আপনার ফিস সম্পর্কে–
কিরীটী বলে, ফিসের কথা থাক— আমি যাবো, কিন্তু আপনাদের ওখানে কি করে যেতে হবে। যদি বলে দেন–
মৃগাঙ্কবাবু বলেন–ইচ্ছা করলে আপনি গাড়িতেও আসতে পারেন-ট্রেনেও আসা যায় এখানে তবে একটু ঘুরে আসতে হয়। তবে যদি স্টীমারে আসেন তাহলে একেবারে ঘাটে এসে নামতে পারেন।
স্টীমার!
হ্যাঁ–আহিরীটোলা ঘাট থেকে সকাল-দুপুর ও সন্ধ্যায় তিনবার স্টীমার আসে।
স্টীমারেই তাহলে যাবো।
আজই আসবেন কি?
কাল যাবো।
বেশ-কোন স্টীমারে আসবেন বলুন-ঘাটে আমাদের লোক রাখব।
আপনিই বলুন না কোন স্টীমারে যাবো—
সকাল দশটা দশের সীমারে আসতে পারেন
বেশ তাই যাবো।
জেটিতে লোক থাকবে।
আচ্ছা। আর একটা কথা।
বলুন।
মৃত দেহটা কি ময়না তদন্তের জন্য পাঠান হয়েছে?
না–
তাহলে ওটা আমি যাওয়া পর্যন্ত রাখবার ব্যবস্থা করবেন। করবো।
নমস্কার |
কিরীটী হাঁক দিল, জংলী।
ভৃত্য জংলী ঘরে প্রবেশ করল; বাবু?
দেখ, কাল সকলে আমাকে একবার শ্ৰীপুরে যেতে হচ্ছে। ফিরবো কখন ঠিক করে বলতে পারছি না। কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে। তবে তাকে বলিস সন্ধ্যার পরে যেন আসে।
কিরীটী জংলীর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা আবার তুলে নিল।
হ্যালো 3033 বড়বাজার।
হ্যালো, কে কিরীটী নাকি? রিসিভারে জবাব এল।
কে সুব্রত? হ্যারে। আমি।
কী ব্যাপার?
শ্ৰীপুর চলেছি, যাবি নাকি? —তা হলে তোকে ওখান থেকে কাল সকালে pick up করে নিই।
হঠাৎ শ্ৰীপুর–
আপাততঃ বিশেষ কিছুই জানিনা। সেখানকার জমিদার মিঃ শশাঙ্ক চৌধুরীর বাড়িতে তাদের এক পুরানো চাকর নিহত হয়েছে, তারই তদন্তের আহ্বান এসেছে। তাই ভাবলাম এক এক যাব, যদি সঙ্গে যাস।
যাবো মানে-নিশ্চয়ই যাবো।
কিরীটী হাসতে হাসতে ফোনটা নামিয়ে রাখল।
পরের দিন সকালে।
সাজপোশাক সেরে নিয়ে কিরীটী জংলীকে একটা ট্যাক্সি ডাকতে বললে। ট্যাক্সিতে চেপে কিরীটী সোজা সুব্রতদের বাড়ি আমহাস্ট স্ট্রীটের দিকে চালাতে আদেশ দিল। সুব্রত একপ্রকার প্রস্তুত হয়েই দরজার সামনে অপেক্ষা করছিল। কিরীটী যেতেই সুব্রত চায়ের আদেশ দিল। কিছুক্ষণ পরে ভূত্য চা, নিয়ে এল। চা পান করেই ওরা বের হয়ে পড়ে। এবং ওরা যখন স্টীমার ঘাটে এসে পৌঁছল, কিরীটী রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৭-১০ এর স্টীমার ছাড়তে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকী।
ট্যাক্সিটাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওরা বুকিং অফিসের দিকে এগিয়ে চলল।
কিরীটী স্টীমারে উঠে পড়ল।
সিটি বাজিয়ে স্টীমার ছেড়ে দিল।
বর্ষার গঙ্গা। গৈরিক জলধারা তার দুকুলপ্লাবী।
ইলিশ মাছের নৌকাগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে দুএকটা লঞ্চ বা ফেরী স্টীমার এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। দুজনে এসে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াল।
এই শ্ৰীপুর স্টেটের জমিদারের সঙ্গে তোর আগে কোন আলাপ ছিল নাকি কিরীটী? সুব্রত জিজ্ঞাসা করল।
না-কিরীটী বললে, তবে এদের নাম শুনেছি। মস্ত বড় ধনী লোক, অগাধ পয়সা, দুদুটো মিলের মালিক—
ব্যাপারটা কি মনে হচ্ছে তোর?
বাড়ির পুরানো চাকর অনেকদিনকার লোক—হয়ত জমিদার বাড়ির অনেক কিছুই সে জানত, যে কারণে আকস্মিক মৃত্যুটা তার চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে–আর তাতেই আমার স্মরণাপন্ন হয়েছে
তাই তোর ধারণা?
নচেৎ জমিদার বাড়িতে সামান্য একটা চাকরের মৃত্যু এমন বিশেষ কোন important বা notice করবার মত ব্যাপার নয় যাতে করে আমার মত একজন বেসরকারী সত্যানুসন্ধানীর প্রয়োজন হতে পারে, তাদের। তাই মনে হয়। এই মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোন জটিলতা আছে যার জন্য হয়ত ওরা আমার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে।