রুস্তমজী কঠিন নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, বললাম তো, আমি জানি না।
কিরীটীর দু’চোখের তারায় যেন আগুনের ঝলকা ক্রমে সে এক পা এক পা করে রুস্তমজীর দিকে আসতে আসতে বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলে, আপনি—হাঁ, আপনি জানেন—আপনি জানেন! আপনার চোখ, ঐ পাথরের চোখ—ঐখানেই সেই নীলা! ঐ রক্তমুখী নীলা!…
কিরীটীর ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে তখন। রুস্তমজীও সহসা যেন কেমন চঞ্চল হয়ে খপ করে চোখের ওপরে হাত চাপা দিলেন এবং চীকার করে বললেন, না, না— আমি জানি না, আমি জানি না।
কিরীটী তখন মিঃ সেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিঃ সেন, আপনার এই বন্ধুর চোখের মধ্যেই লুকানো আছে নীলাটা নিয়ে নিন!
বাঘের মতই মিঃ সেন রুস্তমজীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, খুন করব তোকে…চোর…আমার রক্তমুখী নীলা—দে, দে—
অনায়াসেই মিঃ সেন বৃদ্ধ রুস্তমজীকে চিৎ করে মাটিতে ফেলে আঙুল দিয়ে খাবলিয়ে রুস্তমজীর পাথরের চোখটা ছিনিয়ে নিলেন।
ঝরঝর করে রক্ত ছুটে এসে রুস্তমজীর সমস্ত জামা নিমেষে রাঙা করে তুলল এবং সেই রক্তের সঙ্গে চোখের কোটর হতে নীলাটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। পাগলের মতই মিঃ সেন নীলাটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন।
বাড়িতে ফিরে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে মৃদু টান দিতে দিতে কিরীটী বলল, প্রথমে চিঠির সাঙ্কেতিক অর্থ আমি বুঝতে পারি নি, পরে তোমার মুখে মিঃ সেন বর্ণিত সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝলাম B. Y. Bombay, R মানে রুস্তমজীর নামের প্রথম অক্ষর—তখনই আমার কাছে ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল। তাই বলেছিলাম, বম্বে যাব। কেননা শুনেছিলাম তোমার মুখে, রুস্তমজী বোম্বেতেই নাকি থাকেন। তারপর ফোনে যেই শুনলাম মিঃ সেনের পার্শী বন্ধু এখানেই এখন আছেন, তখন বোম্বে যাওয়ার প্রয়োজন আর থাকল না।
একটা কথা, নীলাটা যে রুস্তমজীর সঙ্গেই আছে, কেমন করে বুঝলে?
এ তো খুবই সহজ। তুমি হয়ত জানো না সুব্রত, কোন পাথর ইত্যাদি মানুষ যখন ব্যবহার। করে, সেটা দেহের চামড়ার সঙ্গে স্পর্শ করে থাকা চাই, নচেৎ সকলের ধারণা পাথরের কোন উপকার নাকি পাওয়া যায় না। রক্তমুখী নীলাটা যখন রুস্তমজী চুরিই করেছেন, তখন যাতে সেটা থেকে উপকার পান সেই চেষ্টাই করবেন এবং তা করতে হলেই গায়ের চামড়ার সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে। সেভাবে রাখতে হলে এক আংটি অথবা ‘তাগা’র সঙ্গে পাথরটা যুক্ত করে রাখতে হয়। কিন্তু তাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে ওঁর পক্ষে সবচাইতে ভাল ও সহজ উপায় ছিল, নীলাটা তাঁর পাথরের চোখের তলায় রাখা এবং তা করতে পারলে কারও চোখে পড়বারও সম্ভাবনা নেই…কাজও হবে এবং করলেনও তাই। দোষীর মন কিনা, তাই সর্বদা একটা কালো সান-গগলস ব্যবহার করতে শুরু করেন রুস্তমজী। রুস্তমজীর হাতে আংটি নেই দেখে তাই প্রথমেই তাঁর চোখের গগলস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর চোখের অসুখের সময় ও নীলাটা চুরি যাবার সময় মিলিয়ে দেখো—একটা সুন্দর মিল আছে।
আমার সমস্ত সন্দেহ মিটে গেল। এবং সম্পূর্ণ অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই সোজাসুজি তাঁকে আক্রমণ করলাম
চমৎকার তোমার যুক্তি কিরীটী!
এমন সময় পশের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল, ক্রিং…ক্রিং…ক্রিং…
সুব্রতবাবু?—ওপাশ থেকে প্রশ্ন এল।
হাঁ, বলুন!
আপনার ও মিঃ রায়ের নামে পাঁচ পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা চেক পাঠালাম আমার সেক্রেটারীর হাত দিয়ে। অনুগ্রহ করে ওই সামান্য টাকাটা নিয়ে আমায় বাধিত করবেনা আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলতে পারব না। আমি ফোনটা রেখে এঘরে এসে দেখি সোফার ওপরে হেলান দিয়ে ইতিমধ্যেই কিরীটী কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে।