মিঃ মেটা হাত তুলে নমস্কার করতে করতে বললেন, Glad to meet you Mr. Roy.
কিছুক্ষণ এটা-ওটা আলাপ-আলোচনার পর সহসা একসময় কিরীটী মিঃ মেটার দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার চোখ কী খারাপ নাকি মিঃ মেটা?
মেটা মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, হাঁ, মানে কয়েকমাস যাবৎ আমার একটিমাত্র চোখ উইক হয়ে পড়েছে।
তার মানে?—কিরীটী প্রশ্ন করল।
মানে আমার একটি চোখ ছোটবেলায় নষ্ট হয়ে যায় বাঁ চোখটা একটি মাত্র চোখই আর অবশিষ্ট। অত্যধিক পরিশ্রমে এটাও পাছে উইক হয়ে পড়ে, তাই ডাক্তারের পরামর্শে কালো ফিল্মের চশমা ব্যবহার করছি কিছুদিন হলো।
কতদিন হোল কালো চশমা ব্যবহার করছেন?
বেশিদিন নয়—সাত-আট মাস হবে বোধ হয়, তাই না মিঃ সেন? রুস্তমজী শৈলেশ্বরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
হাঁ, ঐরকমই হবে।
আরো দু’চারটে কথাবার্তার পর রুস্তমজী বললেন, শুনলাম আপনারা আমার বন্ধু সেনের হারানো নীলাটি উদ্ধারের চেষ্টা করছেনা সত্যি নীলাটি হারানো অবধি বন্ধু আমার অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছেন ব্যবসাক্ষেত্রে পর্যন্ত মন দেন না আগের মত নীলাটি যদি উদ্ধার করে দিতে পারেন, আমরা দুজনেই আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
কিরীটী বললে, চেষ্টা করতে পারি, ফলাফলের কথা বলি কেমন করে?
আপনার ক্ষমতার কথা মিঃ সেনের মুখেই আমি শুনেছি মিঃ রায়। কথাটা বললেন রুস্তমজী।
ভৃত্য ট্রেতে করে চা ও জলখাবার নিয়ে এল।
চা পানের পর হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একসময় রুস্তমজী বললেন, কিন্তু মিঃ সেন, এদিকে আবার বেশি দেরী হলে ট্রেন আমরা ধরতে পারব না।
তারপর রুস্তমজী তাঁর পার্টনার ও বন্ধু শৈলেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবারে উঠুন মিঃ সেন। তারপর আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ আমাদের ছেড়ে দিতে হবে মিঃ রায়। একটা বড় জরুরী কাজ হাতে আমাদের—আপনাদের সঙ্গে আর এক দিন ভাল করে আলাপ করব।
সহসা এমন সময় কিরীটীর কণ্ঠস্বরে আমরা সকলেই চমকে উঠলাম। সে গম্ভীর স্বরে বলল, মিঃ রুস্তমজী মেটা, আপনাকে আমি মিঃ সেনের রক্তমুখী নীলাটা চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করছি।
ঘরের মধ্যে সহসা বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।
মিঃ মেটা যেন কিরীটীর কথায় পাষাণের মত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন এবং কালো কাঁচের চশমা পরা চোখ নিয়ে স্থির অচঞ্চল ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
অনেকক্ষণ পরে মিঃ মেটা মিঃ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবের মানে কি মিঃ সেন?
মিঃ সেনও যেন ভয়ানক বিব্রত হয়ে পড়েছেন।
কিরীটী তখন মিঃ মেটার দিকে তাকিয়ে অচঞ্চল কঠিন আদেশের ভঙ্গিতে বলল, লক্ষ্মী ছেলের মত আসন গ্রহণ করুন মিঃ রুস্তমজী মেটা। শুনুন মিঃ সেন, শোন সুব্রত কয়েক মাস আগে রুস্তমজীর সঙ্গে যখন মিঃ সেন মীরাটে ছিলেন, সেই সময়ে নিশ্চয়ই খাবারের সঙ্গে কোন ঘুমের ঔষধ দিয়ে কোন এক রাত্রে রুস্তমজী মিঃ সেনের আঙুল থেকে রক্তমুখী নীলা বসানো সাপ আংটিটা খুলে নিয়ে অন্য একটি নকল পাথর বসানো আংটি পরিয়ে দেন। রুস্তমজীকে হয়ত চিনতে পারছ না, বোম্বের বিখ্যাত পার্শী পাবলিকেশন বিজনেসম্যান—একদা যাঁকে তাঁর নিজ শয়নকক্ষে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়—ইনি তাঁরই ভাগ্নে। কেমন রুস্তমজী? আমার কথা ঠিক কি না? রুস্তমজী নিশ্চয়ই তাঁর মামার কাছে কোন এক সময় হয়ত ঐ নীলাটার সম্পর্কে শুনেছিলেন এবং তাতেই হয়তো নীলাটার ওপরে ওঁর লোভ জন্মায়। মামার মৃত্যুর পর যখন শুনলেন সমস্ত সম্পত্তি নিলামে উঠেছে, তখন তাড়াতাড়ি এলেন নিলামে আংটিটি কিনতে, কিন্তু সেবারে মিঃ সেন বেশি অফার দিয়ে কিনে নিলেন ওঁকে বঞ্চিত করে। ফলে রুস্তমজীর আক্রোশ পড়ল মিঃ সেনের উপর এবং একবার তাঁদের সামনে ও একবার রাত্রে আগ্রাতেই ওঁর বন্ধুর বাসায় আংটিটি নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন ভাবলেন, এভাবে আংটিটি হাতানো যাবে না তখন বন্ধুবেশে ব্যবসার ভাগীদার সেজে এসে মিঃ সেনের সামনে দাঁড়ালেন। কোন পার্শী কোন একজন বাঙালীকে অংশীদার নিয়ে ব্যবসা করবে—এ স্বপ্নেরও অগোচরা মূল উদ্দেশ্য ছিল রুস্তমজীর, এ নীলাটি কোনমতে হাতিয়ে নিজের অধিকারে আনা। মিঃ সেনের ব্যবসার গতি দেখে নীলাটির জন্য আরো লালায়িত হয়ে উঠলেন। দিনের পর দিন কলকাতায় থেকে নীলাটা চুরি করা সম্ভব হবে না জেনেই ব্যবসার ছল করে মিঃ সেনকে মীরাটে নিয়ে গেলেন এবং অনায়াসেই কাজ হাসিল করলেন। বলতে বলতে এবারে কিরীটী হঠাৎ রুস্তমজীর দিকে ফিরে তাকিয়ে কঠোর নির্দেশের ভঙ্গিতে বললে, রুস্তমজী, এবারে বের করে দিন মিঃ সেনের রক্তমুখী নীলাটা!
এতক্ষণে রুস্তমজী কথা বললেন, মিঃ রায়, একজন ভদ্রলোককে এভাবে আপনার মত একজন ভদ্রলোকের পক্ষে অপমান করবার কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না!
মিঃ মেটা, আর রহস্য কেন? আমি জানি নীলাটা আপনার সঙ্গেই আছে!
কি বলছেন আপনি পাগলের মত মিঃ রায়?
ঠিকই বলছি।
বেশ খুঁজে দেখুন…কিন্তু জানবেন, এ অপমান আমিও সহজে হজম করব না।
নিজেই রুস্তমজী তন্ন-তন্ন করে জামাকাপড়, মনিব্যাগ, জুতো, মোজা, টুপি, চুল সবকিছু খুঁজে দেখালেন, কিন্তু নীলাটা পাওয়া গেল না। কিরীটী তখন যেন ক্ষেপে উঠেছে এবং বলে ওঠে, ওসব খুঁজলে কি হবে, ওখানে তো নেই বলতে বলতে সহসা এগিয়ে এসে এক টান দিয়ে রুস্তমজীর চোখ থেকে গগলসটা ছিনিয়ে নিল এবং এক তীক্ষ্ণ আদেশের সুরে বলল, রুস্তমজী, রক্তমুখী নীলা অতি ভয়ঙ্কর জিনিস ভেবে দেখুন আপনার মামার কথা কিভাবে যথাসর্বস্ব খুইয়ে তাঁকে শেষ পর্যন্ত একদিন আত্মহত্যা করতে হয়েছিল কে জানে কোন ভয়ঙ্কর পৈশাচিক মৃত্যু আপনার জন্যও অপেক্ষা করছে কিনা…সর্বনাশ যদি না চান যাঁর জিনিস তাঁকে ফিরিয়ে দিন। ও নীলা— বিশেষ করে রক্তমুখী নীলা সকলের সহ্য হয় না। এই যে দীর্ঘকাল নীলাটার লোভে হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, চুরি করেও কী সেটা লুকোনো রইল? ধরা পড়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। ওর সাহচর্যেও বিষ আছে মিঃ মেটা। রক্তমুখী নীলা বড় সাংঘাতিক বস্তু। এখনও ভাল চান তো যাঁর নীলা ফেরৎ দিন তাঁকেই।