আমি কিন্তু কিরীটীকে এবার বাধা দিয়ে বললাম, তোমার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিরীটী?
না, ট্রেন থেকে নেমে সোজা এখানে চলে এসেছি। বলতে বলতে কিরীটী আমার পাশেই একটা খালি সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লা
রাজু ওরা আসেনি?
না, তাদের শৈলাবাসের আকাঙ্ক্ষা এখনো মেটে নি কী আর করি! হাত-পা গুটিয়ে অমন দিন রাত্রি চুপচাপ হয়ে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন জমাট বেঁধে যাবার যোগাড় হয়ে উঠেছিল কাজে-কাজেই আমি আর থাকতে পারলাম না। জংলীকে নিয়ে সোজা চলে এলাম। জংলীকে ট্যাক্সি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে, বরাবর তোমার এখানেই চলে আসছি। এখান থেকে স্নানপর্ব সেরে তবে গৃহে গমনা ইতিমধ্যে হীরা সিং গাড়ি নিয়ে আসবে। …
আর দেরী করো না তবে, স্নানের ঘরে যাও। আমি ততক্ষণ ভোলাকে দিয়ে কাপড় আর টাওয়েল পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কিরীটী স্নানঘরের দিকে চলে গেল।
৪. মুখোমুখি
বিকালের দিকে কিরীটী আমাদের বাড়িতে এল।
ভোলা গরম গরম চা ও টোস্ট দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে কিরীটীকে গতরাত্রির ঘটনা আনুপূর্বিক সব খুলে বললাম
সমস্ত ঘটনা শোনবার পর কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বলল, মাস্টার, তোমার সকালের সেই চিঠির রহস্য আমার কাছে এতক্ষণে খোলসা হয়ে গেল। কথা কয়টি বলে কিরীটী একগাল পীতাভ ধোঁয়া মুখ থেকে উদগীরণ করলো।
কী,—অর্থ কী? আমি উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলাম।
জলের মত সোজা। কিন্তু কথা হচ্ছে, সত্যি কি তুমি নীলাটা উদ্ধার করতে চাও নাকি?
নিশ্চয়ই।
তবে বোম্বে যেতে হবে।
বোম্বে যেতে হবে? তার মানে?
মানে—মানে আবার কী? বলছি তো বম্বে যেতে হবে–But I am too tired!…
এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে পাশের টেবিলে রক্ষিত টেলিফোন বেজে উঠল। এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললাম, হ্যালো… Yes, Subrata Roy Speaking… অ্যাাঁ, কী। বললেন? বেরিয়ে যাচ্ছেন? জরুরী কাজে? আপনার সেই পার্শী পার্টনারের সঙ্গে?…আজ তাহলে যাব না?
সহসা কিরীটী আমাকে বাধা দিল সুব্রত, ওকে যেতে বারণ কর এবং বল ওর পার্শী পার্টনারের সঙ্গে আজকে যেন কোথাও না যান…আমরা আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওঁর সঙ্গে দেখা করবা …আর জিজ্ঞাসা কর তো—পার্শী মার্চেন্টটি এখানে কোথায় থাকেন?
কিরীটীর কণ্ঠে ভয়ঙ্কর একটা আদেশের সুর।
আমি কিরীটীর কথামত তক্ষুনি মিঃ সেনকে সবই খুলে বললাম মিঃ সেন আপত্তি জানালেন, বললেন, তাঁর পার্শী বন্ধুটি গত সপ্তাহে কলকাতায় এসেছেন। গ্র্যান্ড হোটেলে একটা স্যুট নিয়ে আছেন। আজ রাত্রেই দিল্লী এক্সপ্রেসে মিঃ সেনকে নিয়ে কী একটা বিজনেসের ব্যাপারে তাঁদের পাটনা যাবার কথা।
আমি তখন মিঃ সেনকে কিরীটীর আসবার সংবাদ দিয়ে বললাম, আমি কিরীটীকে তাঁর নীলা সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা বলেছি এবং কিরীটীরই ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে আমি থাকতে বলছি।
মিঃ সেন বললেন, বিজনেসের ব্যাপারে পাটনায় তাঁদের যেতেই হবে, না গেলে সমূহ ক্ষতি হবে। তবে ট্রেন সেই রাত্রি সাড়ে দশটায়া বাড়ি থেকে রাত্রি নটার পর রওনা হলেও কোন ক্ষতি নেই। এর মধ্যে যদি আমরা তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করি তো ভাল হয়—তাঁর পার্শী বন্ধুটিও এখুনি সেখানে আসছেন, তাঁর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেবেন। তিনিও সব জানেন নীলা চুরির কথা এবং তাঁকে সব কথা আজ উনি নাকি দুপুরে বলেছেনও।
আমি কিরীটীকে মিঃ সেনের বক্তব্য সব বললাম।
কিরীটী বললে, তবে মিঃ সেনকে বলল যে, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত উনি যেন বাড়ি থেকে কোথাও না বের হন। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যাচ্ছি।
আমি কিরীটীর নির্দেশমত মিঃ সেনকে ফোনে তাই বলে দিলাম।
মিঃ শৈলেশ্বর সেনের বাড়ি হাজরা রোডে।
টালীগঞ্জে কিরীটীর বাসা হতে আমরা যখন মিঃ সেনের বাসার সামনে হাজির হলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
হাজরা রোডের উপরেই প্রকাণ্ড ত্রিতল সাদা রংয়ের বাড়ি বাড়ির সামনে লোহার গেটা গেটে নেপালী দারোয়ান গেট থেকে লাল কাঁকর বিছানো পথ বরাবর গাড়িবারান্দার নীচ পর্যন্ত গেছে। দু’পাশে টেনিস লন ও নানাজাতীয় ফুল ও পাতাবাহারের গাছের সৌন্দর্য-সমাবেশ
হীরা সিং গাড়িবারান্দার নীচে গাড়ি থামাতেই আমাদের নজর পড়ল অন্যদিকে আর একখানা সিডানবডি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বেয়ারা আমাদের পথ দেখিয়ে উপরে নিয়ে গেল।
দোতলার কোণের দিককার একটি ঘরে মিঃ সেন ছিলেন।
আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে কলস্বরে অভিনন্দন করে ঘরের মধ্যে ডেকে নিলেন, আসুন আসুন!
আমরা তিনজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সর্বাগ্রে আমি, মাঝখানে কিরীটী ও পশ্চাতে মিঃ সেনা
মাঝারি গোছের একখানি ঘর ঘরের মেঝেতে সবুজ রংয়ের মূল্যবান কার্পেট বিছানো, কালো পাথরের তৈরী ঘরের মধ্যখানে একটা ব্রোঞ্জের তৈরী মারকারির প্রতিমূর্তি শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রক্ষিত।
ঘরের দু’পাশে সোফা পাতা তারই একটা অধিকার করে একজন শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধ পার্শী ভদ্রলোক উপবিষ্টা ভদ্রলোকের চোখে কালো কাঁচের চশমা।
আমরা সকলে এক একটি সোফা অধিকার ক’রে বসলামা তারপর কিরীটীকে দেখিয়ে মিঃ সেনকে বললাম, মিঃ সেন, ইনিই আমার পরম বন্ধু কিরীটী রায়। …আর কিরীটী, ইনি মিলিয়নিয়ার আয়রন মার্চেন্টমিঃ শৈলেশ্বর সেন।
দু’জনে দু’জনকে অভিবাদন ও প্রত্যাভিবাদন জানালেন। এবারে মিঃ সেন অদূরে উপবিষ্ট কালো চশমা চোখে পার্সী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, ইনি আমার অংশীদার ও বিশিষ্ট বন্ধু মিঃ রুস্তমজী মেটা। …আর ইনি মিঃ সুব্রত রায়, আমার নবলব্ধ বন্ধু।