মাটি থেকে দোতলার জানালা প্রায় আট-ন হাত উঁচু হবে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখান দিয়ে লাফিয়ে পালানো একপ্রকার অসম্ভব।
বন্ধুরা বললে, ওই রক্তমুখী নীলাটা হাত থেকে খুলে ফেল। ওটাই হয়তো যত নষ্টের গোড়া। …ওটা আঙুলে পরা অবধি যত ব্যাপার ঘটছে।
আমি বললাম, তা হোক, ওটা আমি খুলব না আঙুল থেকে—যত বিপদই আমার আসুক, শেষ পর্যন্ত মরতে হয় তাও স্বীকার। …
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন।
৩. কিরীটী
তারপর?—আমি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
তার পরের দিনই আগ্রা থেকে ফিরে এলাম। দীর্ঘ এক বছর আমার কোন বিপদ-আপদ ছিল না। এদিকে ব্যবসায়েও আমার দিনের পর দিন খুব বেশি উন্নতি হতে লাগল। এমন সময়ে বোম্বাইয়ে এক পার্শী মার্চেন্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। অমন চমৎকার ভদ্রলোক ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমি ইতিপূর্বে দেখি নি। তিনি আমার নূতন হার্ডওয়ার ব্যবসায়ের অংশীদার হলেনা বলা বাহুল্য, নূতন ব্যবসায়েও আমার প্রচুর লাভ হতে লাগল।
এমনি করে আরো বারোটি বছর কেটে গেল। কিন্তু হঠাৎ গত বছর থেকে দেখছি, ব্যবসায়ে আমার অত্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে। পর-পর হাজার হাজার টাকার তিন-চারটে ট্রানজ্যাকশন একেবারে। নষ্ট হয়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা নিজের প্রাইভেট রুমে বসে বসে এইসব কথা ভাবছি, সহসা আমার আংটির কথাটা মনে পড়ে গেল। আংটিটির দিকে তাকালাম। কিন্তু আংটির পাথরটা যেন কেমন-কেমন মনে হল নীলাভ পাথরটার ভিতর থেকে যে একটা রক্তদ্যুতি ফুটে বের হয়, সেটা তো কই দেখা যাচ্ছে না! চমকে উঠলাম এবং তক্ষুনি গাড়িতে চেপে বৌবাজারের এক জুয়েলারের দোকানে গেলাম
জুয়েলার আমার যথেষ্ট পরিচিত আংটির পাথরটা পরীক্ষা করে বললেন, ওটা আসল নীলা পাথরই নয়। সামান্য একটা নীল রঙের কাঁচ মাত্রা আমার মাথা ঘুরে গেল। চারিদিক অন্ধকার দেখলাম।
বাড়িতে ফিরেই পুলিশে সংবাদ দিলামা বাড়ির সব চাকর-বাকরদের নানাভাবে জেরা শুরু করে দিলাম। কিন্তু কোন সুবিধাই হল না।
আমার কিন্তু মন ভেঙে গেল পাগলের মত দিবারাত্র পাথরটার কথাই চিন্তা করতে লাগলাম এমন সময় সহসা একটা বেনামী চিঠি রেজিস্টারী ডাকে পেলাম—এই দেখুন সেই চিঠি!
ভদ্রলোক জামার বুকপকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা মলিন খাম বের করে দিলেন চিঠিটা টেবিল ল্যাম্পের সামনে উঁচু করে ধরলাম। পরিষ্কার ইংরাজী টাইপে লেখা। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—
প্রিয় শৈলেশ্বর,
তোমার আংটির নীলা হারায় নি। আটমাস আগে আমি সেটা চুরি করেছি তোমার আংটিসমেতা তোমার হাতের আঙুলে যে আংটিটি আছে সেটা একটা মেকি পাথর বসানোে অন্য আংটিা শুনলাম তুমি পুলিশের সাহায্য নিয়েছ। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। মিথ্যা সময় ও অর্থের অপব্যয় হবে মাত্র কারণ এ জীবনে আর তোমার সেটা ফিরে পাওয়ার কোন আশাই নেই জেনো। অতএব বুদ্ধিমানের মত কোন গোলযোগ না করে চুপচাপ থাকাই ভালা চুপ করে যাও এবং কেস তুলে নাও।
ইতি,–
B.Y.X.IV.IV.I, তোমার ’R’
আমি তিন-চারবার আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে শৈলেশ্বরবাবুর মুখের দিকে তাকালাম।
এখন বুঝতে পারছেন বোধ হয়, কেন এত গোপনে এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি!–শৈলেশ্বরবাবু বললেন।
আচ্ছা, আট মাস আগে এমন কোন ঘটনা বা উপলক্ষ ঘটেছিল যে আপনি কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছলেন?
না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তাছাড়া অনেক দিন আগের কথা…
আট মাস আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
মীরাটো ব্যবসা সংক্রান্ত একটা ট্রানজ্যাকশনের কাজে আমি ও আমার বন্ধুটি সেখানে মাসখানেক ছিলাম।
আপনার এই পার্শী বন্ধু লোক কেমন?
আগেই তো আপনাকে বলেছি, অমন অমায়িক ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন লোক বড় একটা আমার চোখেই পড়ে নি।
বয়স কত হবে বলে মনে হয়?
তা পঞ্চাশকি ষাট হবে বোধ করি।
পুলিশ কি এখন আপনার কেস ইনভেসটিগেট করছে মিঃ সেন?
না, এই চিঠি পাবার পরই কেসটা আমি উইথড্র করে নিয়েছি।
বেশ করেছেন কিন্তু আজকের মত এই চিঠিটা আপনাকে আমার কাছে রেখে যেতে হবে। কাল সকালে হোক কিংবা রাত্রেই হোক, সুবিধামত আমিই আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। আপনি বাসা থেকে কোথাও বেরোবেন না। তাছাড়া আপনার বাড়িতে তো ফোন আছে?
আজ্ঞে আছে।
এবারে আপনি তাহলে বাড়ি যান। রাত্রি প্রায় শেষ হতে চলল।
শৈলেশ্বরবাবুকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। ভোলার সন্ধান নিয়ে দেখি, বেটা বাড়ি ফিরে সদর দরজা বন্ধ দেখে রোয়াকে শুয়ে পড়েই দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে।
ভোলাকে জাগিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম এবং তারপর উপরে এসে শুয়ে পড়লাম
পরদিন দুপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে কিরীটী শিলং থেকে ফিরে এল আমি ঐ সময়ে বসে মিঃ শৈলেশ্বর সেনের রেজিস্টারী ডাকে পাওয়া চিঠির তলাকার সাঙ্কেতিক অক্ষরগুলো বুঝবার চেষ্টা করছিলাম।
ওহে মিলিয়নিয়ার!
চমকে মুখ তুললাম। দেখি খোলা দরজার সামনে দণ্ডায়মান কিরীটী।
কিরীটী!…আনন্দে আমার গলার স্বর বুজে এল।
হ্যাঁ, কিরীটীই। কিন্তু এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়া হচ্ছিল শুনি?
একটা চিটি।
কার চিঠি? কিরীটী হাসতে হাসতে এগিয়ে এল।
দেখ না।
চিঠিটা আমি কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরলাম।
কিরীটী হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে গুনগুন করে পড়তে লাগল। তারপর সহসা চিঠির শেষে ঐ সাঙ্কেতিক লেখাগুলোর কাছে এসে থেমে গিয়ে পরক্ষণেই আবার বললে, হুঁ, তারিখ দেখছি ১০.৪.৪১—আজ হচ্ছে ২০.০৪.৪১, দিনদশেক আগেকার চিঠি। B.Y. কথাটি কি? আর নীচের এই নামের বদলে ‘R’ অক্ষরটাই বা কী মীন করছে? নামের অক্ষর নয় তো? কি নাম—রজত, রমেন, রমেশ?