আপনাকে বলব কি সুব্রতবাবু, আংটিটি আঙুলে পরবার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব শরীর আমার যেন সহসা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল, একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ যেন আমার শরীরের সমগ্র স্নায়ুকোষকে তরঙ্গায়িত করে গেল—মাথাটার মধ্যে কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল, বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলাম।
সেদিনই সন্ধ্যাবেলা তাজের দিকে বেড়াতে গেছি, সঙ্গে আছে কলকাতা থেকে আগত জীবনকুমার সেন নামে আমাদের আর এক বন্ধু।
তাজের পাষাণচত্বরে আমরা তিনবন্ধু বসে আছি। এমন সময়ে অদূরবর্তী ধূসর সীমান্তের শীর্ষ ছুঁয়ে চাঁদ দেখা দিল তাজের শ্বেতশুভ্র কঠিন পাষাণগাত্রে চাঁদের আলো যেন গলে পড়ছে।
তিনজনই তন্ময় হয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি, সহসা আমার ডানহাতের ওপর কার যেন মৃদু স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে তাকালাম
এক অশীতিপর বৃদ্ধ পার্শী ভদ্রলোক। তাঁর পরিধানে সিল্কের চোগাচাপকান, মাথায় শুভ্র চুল, আবক্ষ-বিলম্বিত শুভ্র দাড়ি।
তিনিই হঠাৎ বেকায়দাভাবে চলতে গিয়ে আমার হাতের ওপরে পা দিয়ে ফেলেছেন অজান্তে।
ভদ্রলোক অনুতাপমিশ্রিত ভাঙা গলায় বললেন, মাফ কিজিয়ে। মুঝে আপকো নেহি…
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না-না-না, এতে আর কী! তাছাড়া আমারও তো তেমন বিশেষ কিছু লাগে নি।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চলে গেলেন। আমরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলাম। তারপর আমরাও উঠে পড়লাম। বন্ধুর নিজের মটরে করে তাজ দেখতে গিয়েছিলাম, তাজের গেটের বাইরে ড্রাইভার আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমার অন্য দুই বন্ধু উঠে পড়েছেন, আমি গাড়ির ফুটবোর্ডে পা দিয়ে উঠতে যাব, এমন সময় রাত্রির জমাট স্তব্ধতা ভঙ্গ করে পিস্তলের গর্জন শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনের কাঁচের খানিকটা ঝনঝন শব্দে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সকলেই তটস্থ হয়ে উঠলাম
আমার বন্ধু জীবনবাবু যেমন সাহসী তেমন গুণ্ডাধরনের। সে গাড়ির দরজা খুলে এক লাফ দিয়ে নেমে পড়ল এবং ডানদিককার সিঁড়ি ভেঙে তাজ বাজারের যেখানে পাথর ও নানাবিধ সৌখিন জিনিসপত্র বিক্রী হয় সেদিকপানে ছুটল।
আমরা হতভম্ব হয়ে গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম অল্পক্ষণ পরে জীবনকুমার ফিরে এল। এসে বলল, না, কাউকেই দেখা গেল না—বেটা পালিয়েছে।
আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা গাড়িতে চেপে রওনা হলাম বাড়ির দিকে।
তাজ গেট হতে বার হয়ে কংক্রিটের সরু রাস্তা বরাবর আগ্রা ফোর্ট স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশে নানারকমের গাছপালা মৃদু চন্দ্রালোকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে যেন স্বপ্নের মতা মাঝে মাঝে হাওয়ার মৃদুমৃদু দোলায় পাতাগুলো সিপ সিপ শব্দ করে।
আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির মধ্যে আমরা সকলেই চুপচাপ বসে আছি। কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘটনাটা যেন আগাগোড়া রহস্যময়। …
সেদিন গভীর রাত্রে দোতলার ঘরে আমি আর জীবনকুমার পাশাপাশি শয়ন করেছি। সহসা একসময় একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
ঘর অন্ধকারা খোলা জানলা-পথে আকাশের দিকে তাকালাম তারায়-ভরা একটুকরো আকাশ, যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের একটুখানি ছোঁয়া।
চাঁদ বোধ হয় তখন আকাশের একপ্রান্তে হেলে পড়েছে।
আবার খস খস শব্দ। মনে হল, কে বুঝি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘরের মধ্যে চলে বেড়াচ্ছে।
কে?–বলে উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম।
নিশ্চয় কেউ ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে। কিন্তু কে? চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে শুয়ে– শুয়েই মৃদু আলো-ছায়া-ভরা ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলাম
একসময় চোখে পড়ল একটা লম্বা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি নিঃশব্দ অন্ধকারে দুলতে দুলতে যেন আমার শয্যার দিকে অতি সাবধানে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি বুঝতে পারছি—অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সমগ্র শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে।
ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
এতক্ষণে ভাল করে শিয়রের কাছে দণ্ডায়মান মূর্তির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। একমুখ ভর্তি কালো কালো দাড়ি নিয়ে সেই মূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অস্পষ্ট আলোছায়ায় তার চোখের মণি দুটো যেন ধক ধক করে জ্বলছে। দু’খণ্ড অঙ্গারের মতই। কী কুর, বীভৎস সেই দৃষ্টি! যেন কুৎসিত ভয়ঙ্কর একটা বন্য লালসা সে দৃষ্টির মধ্যে লেলিহান হয়ে উঠেছে।
মূর্তির গায়ে একটা কালো রঙের চাদর। চাদরটা মাথার ওপরে ঘোমটার আকারে তুলে দেওয়া। ঘোমটা কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে, হাত দুটি বুকের ওপর ভাঁজ করে মূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ইচ্ছা হচ্ছিল চীৎকার করে বাড়ির সকলকে জাগিয়ে তুলি। কিন্তু কী সম্মোহন দৃষ্টি সে ক্ষুধিত চোখের তারায় কণ্ঠের সমস্ত শক্তি আমার অবশ হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে এক সময় লোকটা তার চাদরের ভিতর হতে একটা দীর্ঘ হাত বের করে বিছানার একপাশে রক্ষিত আমার ডানহাতটা চেপে ধরতেই আমি ধড়মড় করে উঠে বসে চীৎকার করে উঠলাম, চোর চোর!
বিদ্যুৎগতিতে আমার ডানহাতের আঙুলে একটা যেন মোচড় দিয়েই মূর্তিটা খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার চীৎকার শুনে জীবন ততক্ষণে ধড়মড় করে শয্যার উপরে উঠে বসেছে। বাড়ির আর সকলেও জেগে উঠল।
আমার মুখে সব কথা শুনে সকলে মিলে খোঁজাখুঁজি করা হল, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।