আমি চেয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের ডান হাতের অনামিকায় একটি সাপ আংটি আংটির সাপের মাথায় মটরের আকৃতির একখানি নীলা পাথর বসানো। …আংটির পাথরটা বুঝি নীলা? আমিই শৈলেশ্বরবাবুকে প্রশ্ন করলাম
হ্যাঁ, রক্তমুখী নীলা ছিল। ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জবাব দিলেন।
ছিল মানে! এখনও তো মনে হচ্ছে–নীলাই।
না, এটা নীলা নয়—সামান্য একটা নীল রংয়ের কাঁচমাত্র।
নীল রং-এর কাঁচ! তবে কি সত্যি ওটা নীলা নয়? এই বলে আমি বিস্মিতভাবে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম।
শৈলেশ্বরবাবু ঘাড় দোলালেন, না।
তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে বললেন, সুব্রতবাবু, আপনাকে এত রাতে অন্যায়ভাবে বিরক্ত করতে আসবার কারণ আমার আংটির রক্তমুখী নীলাটি হারিয়ে গিয়েছে। তাই। যেমন করে যে উপায়েই হোক আপনাকে নীলাটি আমার উদ্ধার করতে দিতেই হবে।
বলতে বলতে সহসা ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে তাঁর দু’হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে বললেন, সুব্রতবাবু, লক্ষ লক্ষ টাকার লোহার কারবার আমার। ব্যাঙ্কেও আমার বহু টাকা সঞ্চিত আছে। নীলাটির বিনিময়ে আমি সব দিতে রাজি আছি। আপনি আমার নীলাটি শুধু যে করেই হোক উদ্ধার করে দিন আমি আপনার ক্রীতদাস হয়ে থাকব।
উত্তেজনায় শৈলেশ্বরবাবুর কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।
আমি আমার হাতের উপর রক্ষিত শৈলেশ্বরবাবুর হাতটির উপর মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, ব্যস্ত। হবেন না, শৈলেশ্বরবাবু আমার কথা বিশ্বাস করুন, নীলা যদি সত্যি কেউ চুরি করে থাকে, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেটা উদ্ধার করে দিতে …আর আমার বন্ধু কিরীটীকে তো জানেন, আমি যদি না পারি, তাকে আমি তার করে দেব—সে এলে আপনার নীলা ফিরে পাবেনই।
আঃ, আমাকে বাঁচালেন সুব্রতবাবু। ভদ্রলোক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে সব এবারে খুলে বলুন তো শৈলেশ্বরবাবু। কোন কথা গোপন করবেন
জানবেন কোন কথা গোপন করলে আমার অনুসন্ধানে ব্যাঘাত ঘটবো আর তাছাড়া আমার ও আপনার মধ্যে যদি একটা ভালরকম বোঝাপড়া না থাকে তবে আমার পক্ষে কারো হয়ে কাজ করাও সম্ভব হবে না—একথা আপনাকে আগে থেকেই কিন্তু জানিয়ে রাখছি।
নিশ্চয়ই–নিশ্চয়ই সেকথা একশবার।
২. রক্তমুখী নীলার ইতিহাস
শৈলেশ্বরবাবু বলতে লাগলেন, সুব্রতবাবু, নীলাটার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আমার বয়স বর্তমানে ছাপ্পান্ন। বছর পনের আগে আমার বয়স যখন একচল্লিশ তখন আগ্রায় একটা নিলামে এক বিখ্যাত পার্শী মার্চেন্টের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে হৃত সেই রক্তমুখী নীলাটা আমি কিনেছিলাম নীলাটা এই সাপ আংটির মাথাতেই বসানো ছিল।
সেই পার্শী মার্চেন্টের ছিল প্রকাণ্ড পাবলিশিং বিজনেস। সেই রক্তমুখী নীলার আংটিটা পরবার পর থেকেই তাঁর ব্যবসায়ে হু-হু করে লাভ হতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সকালে সেই পার্শী মার্চেন্টকে তাঁর ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ভদ্রলোক নিজের রিভলবার দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন ভদ্রলোকের সংসারে আপনার বলতে আর কেউ ছিল না থাকবার মধ্যে ছিল এক দূর-সম্পর্কীয় ভাগ্নে। ঐ আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ নিয়ে এদিকে ভাগ্নের কাছে তার গেল। ঐ দুর্ঘটনার দিনতিনেক পরে শোনা গেল, সেই পার্শী মার্চেন্টের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি এক লক্ষপতি সুদখোরের কাছে বাঁধা আছে। উনি নাকি নূতন কি একটা ইনভেস্টমেন্টে টাকা ঢালতে গিয়ে মৃত্যুর আগে সাতদিনের মধ্যেই যথাসর্বস্ব খুইয়েছিলেন।
মার্চেন্টের সব সম্পত্তি নিলামে উঠল। আমি তখন আগ্রায় আমার এক বন্ধুর বাসায় পুজোর ছুটি কাটাচ্ছি। বন্ধুর মুখে নিলামের কথা শুনে সেখানে গেলাম। কেননা খুব ছোটবেলা থেকেই নিলামে জিনিসপত্র কেনা আমার একটা নেশা ছিল। সেখানে গিয়ে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে নীলার আংটিটিও দেখলাম চমৎকার আংটিটি।
শুনলাম নীলার আংটিটির একটা ইতিহাস আছে। আংটিটি ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম আলীরা একদিন রাত্রে নবাব যখন ঘুমন্ত অবস্থায় তখন কোন গুপ্তচর তাঁর আঙুল হতে আংটিটি চুরি করে নিয়ে যায়। এবং তারই কিছুকাল পরে উদয়নালা দুর্গের পতন হল ও সেই সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শেষ আশার প্রদীপটুকুও নিভে গেল। তারপর বহু হাত ও বহু উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে আংটিটি এক পাঠান দস্যুর হাতে পড়ে। দস্যুটি ধরা পড়ার পর গভর্নমেন্টের হাতে আংটিটি যায় এবং সেখান হতে পার্শী মার্চেন্টটি একুশশ’ টাকায় আংটিটি কিনে নেন। একটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত রূপার ডিশে আংটিটি রক্ষিত ছিল। সোনার একটা সাপ-আংটি। একটি সাপ একটি সরু সোনার তারের মত, তারই মাথায় সুবৃহৎ মটরদানার মত একটি রক্তমুখী নীলা বসানো। নীল স্ফটিকের মধ্যে যেন একটি রক্তদ্যুতি নীলাভ এক ফোঁটা জমাট রক্ত যেন আশ্চর্য সুন্দর।
অন্ধকারে আংটির পাথরটা সাপের চোখের মত জ্বলে সমস্ত দিনরাত্রে আলোর তারতম্যের জন্য পাথরের মধ্যেও রঙের রূপান্তর ঘটে। বলা বাহুল্য আংটিটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এবং তক্ষুনি মনে মনে স্থির করলাম, যত দামেই হোক আংটিটি আমি কিনব।
আমি ও আর একজন আমার চাইতে বয়সে কিছু বড় পার্শী ভদ্রলোকের মধ্যে দর-কষাকষি চলতে লাগল নীলাটা নিয়ে। শেষটায় সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে আংটি আমি কিনে নিলাম এবং তখুনিই আঙুলে পরলাম।