নীলিমা বললো, তাই নাকি?
আমি বললাম, আমার জীবন কাহিনী শোনার অনেক অবকাশ পাবেন, আজ থাক। যদি লিখতে পারত তবে বীণা মাসি আমার জীবন নিয়ে একটা রামায়ণ লিখত। ভাগ্য ভাল বীণামাসির কলম চলে না, শুধু মুখ চলে। কিন্তু তার ঠেলাতেই আমি অস্থির।
নীলিমার সঙ্গে সেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হলো। দশ-বারে দিন পরে বীণামসির ওখানেই আমাদের আবার দেখা। সেদিন দুজনেই একসঙ্গে বেরুলাম। তারপর কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত একসঙ্গে হেঁটে গিয়ে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম।
ঐ সামান্য আলাপ-পরিচয়তেই আমি যেন কেমন পালটে গেলাম। সকালবেলার টিউশানিতে একটু একটু ফাঁকি দিয়ে ও স্নানআহারের পর্ব কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত করে দৌড়ে দৌড়ে সওয়া দশটার আগেই কলেজে আসা শুরু করলাম। কোনদিন দেখা হয়, কোনদিন হয় না; কোনদিন কথা হয়, কোনদিন হয় না। কোনদিন আবার দূর থেকে একটু তিৰ্যক দৃষ্টি আর মুচকি হাসি-বিনিময়। তার বেশী আর কিছু নয়। কিন্তু তবুও আমি কেমন স্বপ্নাতুর হয়ে পড়লাম। নীলিমাকে কো-পাইলট করে আমি আমার কল্পনার উড়ো-জাহাজ নিয়ে টেক অফ করলাম। ভাব-সমুদ্রে ভেসে বেড়ালাম।
ঐ শুধু একটু মুচকি হাসি ও ক্ষণিকের দৃষ্টি-বিনিময়কে মূলধন করে আমি অনেক, অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। টোপর মাথায় দিয়ে নীলিমার গলায় মালা পরিয়েছিলাম, পাশে বসে বাসর জেগেছিলাম। বৌভাত-ফুলশয্যার দিন গভীর রাত্রে অতিথিদের বিদায় জানিয়ে আমি নীলিমার ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করলাম। নীলিমার পাশে বসে একটু আদর করলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে সুইচটি অফ করতে গিয়েই দারুণ শক লাগল। আমার কল্পনার জাহাজ ক্রোশ ল্যাণ্ড করল। কো-পাইলট নীলিমাকে আর কোথাও খুজে পেলাম না।
সাহস করে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। মহা উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল। নীলিমা-বিহীন জীবন প্ৰায় অসহ্য হয়ে উঠিল। বৈরাগ্যের ভাব মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উকি দিতে লাগল। আর কয়েক দিনের মধ্যে খবর না পেলে হয়ত কেদার বদ্রীর পথেই পা বাড়াতাম। ভগবান করুণাময়। তাই সে যাত্রায় আর সংসার ত্যাগ করতে হলো না, নীলিমার দেখা পেয়ে গেলাম।
দেখা পেলাম বীণামাসির বাড়িতেই। নীলিমার কপালে অতি বড় একটা সি দুরের টিপ দেখে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম মনে মনে। প্ৰথমে ঠিক সহজ হয়ে কথাবার্তাও বলতে পারিনি। নীলিমা বোধহয় আমার মানসিক দ্বন্দ্বের ভাষা বুঝেছিল। তাই সে নিজেই বেশ সহজ সরল হয়েছিল আমার সঙ্গে।
জান দোলাবৌদি, নীলিমার বিয়ে হবার পরই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হলো। কোন কাজে-কর্মে সাউথে গেলেই কালীঘাটে নীলিমার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। নীলিমার স্বামী সন্তোষবাবু আজ আমার অন্যতম বিশেষ বন্ধু ও শুভাকাজক্ষী। ওরা এখন আমেদাবাদে আছেন। সন্তোষবাবু একটা বিরাট টেকসটাইল মিলের চীফ অ্যাকাউন্ট্যাণ্ট। এক গাদা টাকা মাইনে পান। নীলিমা আমেদাবাদ টেগোর সোসাইটির সেক্রেটারী। তোমার বোধহয় মনে আছে সেবার গোয়া অপারেশনস কভার করে দিল্লী ফেরার পথে দমন গিয়েছিলাম এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। গত্যন্তর না পেয়ে সন্তোষবাবুকেই একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্রাম পাঠাই। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছুটে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। দু-সপ্তাহ ওদের সেবা-যত্নে আমি সুস্থ হবার পর নীলিমা মেমসাহেবকে আমেদাবাদ আনিয়েছিল। দু’সপ্তাহ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও কোন খবর না দেবার জন্য মেমসাহেব ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি কিছু জবাব দিতে পারিনি। নীলিমা ওর দুটি হাত ধরে বলেছিল, তোমার সেবা পাবার মত অসুখ হলে নিশ্চয়ই খবর দিতাম। ডক্টর মৈত্রকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম। উনি বললেন, তাড়াহুড়ো করে ওকে আনাবার কোন কারণ দেখি না। একটু সুস্থ হলেই খবর দেবেন।
একটু থেমে দু’হাত দিয়ে মেমসাহেবের মুখটি তুলে ধরে নীলিমা বলেছিল, তাছাড়া ভাই, আমি বা তোমার দাদাও বাচ্চা কে ভালবাসি। তোমার অভাব আমাদের দ্বারা না মিটলেও ওর সেবাযত্নের কোন ত্রুটি করিনি। আমরা।
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে হাসিতে ভরিয়ে তুললো নিজের মুখটা। বললো, নীলিমাদি, আমি তো আপনাদের দুঃখ দিতে চাইনি। তবে আগে এলে হয়ত নিজে মনে মনে একটু শান্তি পেতাম, তাই আর কি…
নীলিমা আর এগুতে দেয় নি। ঐ অধ্যায়ের ঐখানেই সমাপ্তি হলো।
তারপর আরো এক সপ্তাহ ছিলাম। আমেদাবাদে। কাকারিয়ার লেকের ধারে রোজ বেড়িয়েছি আমরা। কত আনন্দ, কত হৈ-চৈ করেছি। আমরা। যাকগে সেসব কথা।
নন্দিনী যখন আমার জীবনে উকি দিয়েছিল, তখন আমি চমকে গিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি, ভাববার সাহস হয় নি যে একটি মেয়ে আমার জীবনে আসতে পারে বা আমাকে কোন মেয়ে তার জীবনরথের সারথী করতে পারে। যেদিন নীলিমার দেখা পেলাম, সেদিন কি করে এই সংশয়ের মেঘ কেটে গেল জানি না। তবে একথা সত্য যে রূপকথার রাজকুমারীর মত নীলিমার ছোয়ায় আমার ঘুম ভেঙেছিল, আমি কৈশোর থেকে সত্যি সত্যিই যৌবনের সিংহদ্বারে এসে উপস্থিত হলাম।
নীলিমার কথা আজ পর্যন্ত কাউকে জানাই নি। এসব জানাবার নয়। এ আমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এমন কি নীলিমাও জানে না, হয়ত ভবিষ্যতেও জানতে পারবে না।
তবে মেমসাহেবকে বলেছিলাম। মেমসাহেব কি বলেছিল। জান? বলেছিল, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যে তোমার মাথাটা ঘুরে যায়, তা আমি জানি। আমার মত কালো কুচ্ছিৎ মেয়েকে যে তোমার পছন্দ হয় না, সে কথাটা অত ঘুরিয়ে বলার কি দরকার?