এসব কথা ভাবতে গেলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। মাথাটা ঝিমঝিম করে, বুকের মধ্যে অসহ্য ব্যথা করে, হাত-পা অবশ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে ভাবি ও হতচ্ছাড়ী পোড়ামুখীর কথা আর ভাবব না, আর কোনদিন মনে করব না। ওর স্মৃতি। ওর স্মৃতিকে ভুলবার জন্যই হয়ত দুটি-একটি বান্ধবীর সঙ্গে একটু বেশী মেলামেশা, একটু বেশী মাতামাতি করেছি। কখনও কখনও। কিন্তু এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে এসেছি। অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মেমসাহেব সহ্য করতে পারত না। বলত, ওগো, তুমি অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করো না।
আমি জিজ্ঞাস করতাম, কেন? আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি?
তা জানি না, তবে আমার বড় কষ্ট হয়।
সেই স্মৃতি, সেই কথা, মেমসাহেবের সেই মুখখানকেই, মনে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আমি পালিয়ে আসি ঐ সখী বান্ধবীর কাছ থেকে। তাছাড়া ও যদি অন্য ছেলেদের সঙ্গে একটু হাসি-ঠাট্টা বা গল্প-গুজব করত, তাহলে আমিও তো সহ্য করতে পারতাম না! সেবার দাৰ্জিলিং-এ গিয়ে ও যখন আধঘণ্টার কথা বলে ঘন্টা-দুই ধরে ইউনিভার্সিটির পুরান বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরে এলো, তখন ওকে আমি কি ভীষণ বকেছিলাম। সুতরাং আজ আমায় কি অধিকার আছে বনানী, চন্দ্রাবলী বা অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে যত্রতত্র বিচরণ করবার? আমি যে অধিকার ওকে দিতে পারিনি, সে অধিকার আমি উপভোগ করি কোন মুখে?
তাইতো ওদের সবার কাছ থেকে পালিয়ে আসি। পালিয়ে আসি গ্ৰীণ পার্ক। মেমসাহেবের সংসারে। ওর নিজে হাতে লাগান কাঠচাঁপা গাছে একটু জল দিই, বারান্দায় ডেকচেয়ারটাকে ঠিক করে রাখি। ড্রইংরুমে গিয়ে অর্গানটাকে একটু পরিষ্কার করি, মেমসাহেবের পোর্ট্রেটটা একটু বাঁকা করে ঘুরিয়ে রেখে ওর মুখোমুখি বসে থাকি।
আগে ভাবতাম কাজকর্ম শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনব। ভাবতাম, দু’টো-একটা গান শোনাবার পর ও বলবে, সারাদিন বাদে বাড়ি ফিরলে। আগে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও। তারপর আবার গান শোনাব।
আগে তুমি গান শোনাও। পরে স্নান করব।
লক্ষ্মীটি, আগে খাওয়া-দাওয়া সোরে নাও, পরে গান শুনে। খাওয়া-দাওয়ায় এত অনিয়ম করো না।
মেমসাহেবের কণ্ঠস্বর চিরদিনের মত শুদ্ধ হয়ে গেছে। আজ আমি যত অনিয়মই করি না, কেউ নেই; আমাকে শাসন করবার। কেউ নেই আমাকে বাধা দেবার। আর গান? চিরকালের জন্য আমার জীবন থেকে সুর আর ছন্দ বিদায় নিয়েছে।
টেপ-রেকর্ডারে কত বড় বড় শিল্পীর কত অসংখ্য গান তুলে রেখেছি। কোন কোনদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রইংরুমে বসে ঐসব গান শুনি । গান শুনতে শুনতে হারিয়ে ফেলি নিজেকে। কোনদিন ৩য়ত ঘুমিয়ে পড়ি। গজাননন এসে ডাক দেয়, ছোটোসাব, অনেক রাত হয়ে গেছে, ফিরে যাও, খাওয়া-দাওয়া করবে তো?
আমি একটু মুচকি হেসে বলি, গজানন, খাওয়া-দাওয়া করে যদি শান্তিতেই ঘুমাব, তাহলে তোমার বিবিজীকে হারাব কেন?
গজানন লুকিয়ে কাপড়ের কোণা চোখে দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। বলে, ছোটোসাব, তুমি এমন করে নিজেকে কষ্ট দিলে বিবিজীরও কষ্ট হবে।
গজাননের কথায় আমি পাগল উঠি। হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠি। যা-তা বলে গজাননকে গালাগালি দিই, ফালতু বাত্ মাত্ কহো। ননসেন্স, ইডিয়েট, রাসকেল। বিবিজীর কষ্ট হবে? তোমার বিবিজীর ছাই হবে। আমাকে জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিল যে-মেয়ে, তার আবার কষ্ট হবে?
কি আশ্চর্য! গজানন আমার কথায় রাগে না, কঁদে!
এই হতচ্ছাড়া গজাননটা হয়েছে আমার আর এক জ্বালা৷৷ ও হতভাগার কোন চুলোয় যাবার জায়গা নেই। বেটাকে তো বহুকাল আগেই খেয়ে বসে আছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল। রিটায়ার করার পর সেই যে আমার ঘাড়ে চেপেছে আর নামছে না। কত বকি, কত গালাগালি দিই। কতবার বলি, দূর হয়ে যা। কিন্তু হতভাগা নড়বে না। জগদল পাথরের মত আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। বেশী কিছু বললে হাউমাউ করে এমন কান্নাকাটি লাগবে যে আমি আর কিছু বলতে পারি না। মাঝে মাঝে মন-মেজাজ ভাল থাকলে জিজ্ঞাসা করি, গজানন, মাইনে নেবে না?
গজানন অবাক হয়ে বলে, মাইনে? আমি টাকা নিয়ে কি করব ছোটসাব? তুমি খেতে পরতে দিচ্ছ, আমার আবার কি চাই?
একটু পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে, তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমি কি হিসাব-নিকাশ করব? যার সঙ্গে হিসাব নিকাশ করব ভেবেছিলাম, সেই তো সব হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে চলে গেল।
ওর এই কথা বলার পর কি আর কিছু বলা যায়? আমি চুপ করে যাই।
এতবড় বাড়িতে একলা থাকে বলে গজাননকে মাঝে মাঝে নানা রকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করে। ও কাউকে বলে, বিবিজী বিলেতে পড়তে গেছে, ক’বছর পর ফিরবে। গ্রীন পার্কের অধিকাংশ লোকই জানে মেমসাহেব বিলেতে পড়তে গেছে। কাউকে কাউকে বলে, বিবিজীর বাচ্চা হবে বলে কলকাতা গেছে।
আমি কখনও কখনও জিজ্ঞাসা করি, হ্যাঁরে, এইসব আজে-বাজে কথা বলে। লাভ কি?
ও বলে, আমাদের ঘরের কথায় ওদের কি দরকার? আমরা কি ওদের ঘরের খবর জানতে চাই?
গজাননকে দেখে মাঝে মাঝে আমি সত্যি নিজের কষ্ট ভুলে যাই। গ্ৰীন পার্কের বাড়িটাকে ও এত সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে যে কি বলব! ড্রইংরুম, বেডরুম, কিচেন, বাথরুম সব ঝকঝাক তকতক করছে। লনে পর্যন্ত একটু নোংরা পাওয়া যাবে না। দেখে কেউ ভাবতে পারবে না যে মেমসাহেব নেই, মেমসাহেব। আর কোনদিন আসবে না। মাঝে মাঝে আমিও ভারতে পারি না। মনে হয় গাড়িটা নিয়ে মেমসাহেব একটু কেনা-কাটার জন্য কনট্রপ্লেসে গেছে, এক্ষুনি এসে পড়বে।